সে এক দিন ছিল। জমি ছিল। গাই ছিল। নটকোনার দোকান ছিল। স্বচ্ছন্দে চলে যেত, বছর বছর কিছু উদ্বৃত্ত হত। সে টাকা আবার খাতকের কাছে খাটত, দেড়ি সুদে। আর বাপ খাটত মোষের মতো, ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত। আমাদেরও খাটাত। বাপ খুব রাগী ছিল। মা-তো যখন তখন মার খেত। তবু কখনও কিছু বলত না। বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল একটা বাঁধানো সেলাই, তাতে লেখা ছিল, শাসন করা তারেই সাজে, সোহাগ করে যে। বাপ আমাদেরও পেটাত, পাঁচন দিয়ে। আমরা নয় ভাই-বোন। বোনেদের ছোটবেলাতেই বিয়ে হয়ে যায়। কেউ ইস্কুলের মুখ দেখেনি। “পরের ঘর যাবে, তার আবার লেখাপড়ার দরকার কী?” অকাট্য যুক্তি। ভাইরা ইস্কুলে যেতাম, কিন্তু প্রায়ই কামাই হত। মাঠ ভর্তি কাজ, আর বাবু ইস্কুলে গিয়ে লাটসাহেব হবেন, জজ-ম্যাজিস্টর হবেন? কথা তো নয়, যেন লঙ্কাবাটা। কিন্তু তাকেই আবার দেখেছি তার হাঁটুর বয়সি পুরুতকে গড় করতে। সরকারি কর্তারা হলে তো কথাই নেই, একেবারে সাষ্টাঙ্গ। আর কী কী ভেট দেবে, মাছ, কলার কাঁদি, তরমুজ, ঘি— তাই নিয়ে বেয়াকুল হয়ে পড়ত।
হবে না-ই বা কেন? “যে সাপের যে মন্ত্র বাপ! মজুর-মুনিষদের যত পারিস খাটা, এমন খাটা যে কথা বলবার ফুরসতও যেন না পায়। কথা বলতে পারলেই তো গোলমাল, তখন তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। কিন্তু, আমলা-অপিসারদের বেলা অন্য কথা। সাত কথা বল্লেও হেঁ হেঁ করে যাবি। জালে মাছ না পড়লে বাজার থেকে সব চেয়ে বড় কাতলাটা কিনে নিয়ে যাবি, বলবি, হুজুর, আমাদের পুকুরের মাছ। বাড়িতে যখন আসবে গাড়ি ভর্তি করে পাঠাবি। তার পর তোকে আর আটকায় কে? জমির বন্দোবস্ত, ঠিকাদারি, দোকানের লাইসেন্স, যে কাজই হোক না কেন সব।” বাপ বুড়ো আঙ্গুল আর মধ্যমা ঘষে চটাক আওয়াজ করত। আর, বুড়ো আঙ্গুলের ডগা তর্জনীতে ঘষে টাকা গোনার ভঙ্গি ছিল তার মুদ্রাদোষ। টাকা ছিল প্রাণ। ইস্কুলে যখন যেতাম, কোনও দিন একটা সিকি দিত, কোনও দিন তাও না। বলত, ঘরে খেয়ে যাবি, মুড়ি বেঁধে নিয়ে যাবি। পয়সার দরকার কী? মা লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু পয়সা জমাত, তাই থেকে কখনও সখনও দিত। বাপ ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে ভয় পেত, ব্যাঙ্ক যদি ফেল হয়ে যায়? তার চেয়ে ভাল টাকা খাটানো, খাতক মরে গেলে তার ব্যাটা আছে, ব্যাটার ব্যাটা আছে। খেটে শোধ করবে। করতও। চাষের যত মজুর-মুনিষ লাগত, তার বেশির ভাগটাই হয়ে যেত কর্জার সুদের বাবদে।
এত টাকা-টাকা করত কেন? “জানিস এক সময় বামুনরা আমাদের ছোঁওয়া জল পর্যন্ত খেত না। সে অনেক কাল আগের কথা, তোরা জানিস না। আমি শুনেছি ঠাকুরদার কাছ থেকে। তার পর কেরমে কেরমে যখন টাকার জোর বাড়ল, তখন আমরা জলচল হলাম। তার মানে, টাকা থাকলে সব আছে, না হলে কিচ্ছুটি নেই। লেখাপড়া আমাদের কপালে নেই, লেখাপড়া করেও বেশি কিছু করতে পারবি না। ডাক্তার উকিল ব্যারিস্টার সব হবে বামুন-কায়েতরা। চির কালের নিয়ম। তার চেয়ে মাটি চটকা, টাকা বাড়া, টাকা থাকলে জজ না হয়েও তুই জজ।” আমার বড়দাদা কলেজে পড়তে যেতে চেয়েছিল। যেতে দেয়নি। তখন প্রাইমারি ইস্কুলে চাকরি পাওয়া যেত, তাতেই ঢুকিয়ে দিল। আর বিয়ে দিয়ে দিল। টাকা তুলতে হবে না? তিন মেয়ের বিয়েতে যত খরচ হয়েছে, তার পুরোটা তোর বিয়েতে তুলতে হবে। তুলেও ছিল। দাদার শ্বশুরের জমি বিক্রি করিয়ে ছেড়েছিল। আমার চাকরি-করা ছেলে, কুড়ি হাজারের এক পয়সা কম নেব না। সে কালে কুড়ি হাজার মানে এখন কুড়ি লাখ। টাকার ব্যাপার হলে বাপের কাছে আত্মীয়-বন্ধু সম্পর্ক অবান্তর। শুধু আমার বাপই নয়, কাকা-জ্যাঠা-মামা-মেসো, আমাদের কুলের সবাই এক রকম। তা বলে সবাই যে খুব টাকাওয়ালা ছিল তা নয়। কেউ কেউ তো মজুরও খাটত। তবে হ্যাঁ, বাগদি-সাঁওতালদের সঙ্গে বাপ যে ব্যবহার করত, নিজের জাতের মজুরদের সঙ্গে তেমন করত না। যেমন, নিজের জাতের মজুররা বাপের সঙ্গে বসে খেত। খাবার দিতে অসুবিধা নেই, টাকা তো লাগছে না। টাকা না লাগলে নিজের জাতের দিকে বাপের খুব দরদ ছিল। আর ছিল পুজো-আচ্চার প্রতি টান, আর অন্য জাতের ছোঁওয়া বাঁচিয়ে চলার বাতিক। রোজ সন্ধেয় উঠোনে গঙ্গাজল ছিটাতো, বাগদি-সাঁওতাল-মুসলমান মজুররা চলে যাওয়ার পর।
তা, বাপ বেঁচে থাকতেই দিন বদলাতে লাগল। প্রকাশ্যে মহাজনী কারবার বন্ধ হল, তার চেয়ে বড় কথা মজুরদের মুখে কথা ফুটল। তত দিনে আমরা বড় হয়েছি। বাপ গোঁয়ার্তুমি করত, আমরা তখন বুঝিয়েবাঝিয়ে থামাতাম। বাবা গো, সময় বদলেছে, যে দিকে বৃষ্টি সেই দিকে ছাতা আড়তে হবে। জজ-ব্যারিস্টার নয়, এখন পার্টি হচ্ছে রাজা, পার্টির সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে। মিলেমিশে চলতে চলতে নিজেদেরও খানিক বদলাতে হল, ছেলেপিলেদের পড়তে পাঠানো, তাদের জন্য টিউশন মাস্টার, এই সব চলতে লাগল। বাপ যতই বলুক, লেখাপড়া করে আমাদের জজ-ব্যারিস্টার হওয়া হবে না, নাই-নাই করেও ছেলেদের ইস্কুলে পাঠানোটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মেয়েদের ইস্কুল যাওয়া অবশ্য অনেক পরে বেড়েছে।
এ দিকে আবার বাজারের রং বদলাতে লাগল। আমরাও সেই রং-এ মিশে গেলাম। টাকা খাটানোর নতুন নতুন রাস্তা খুলে গেল, সার-কীটনাশকের দোকান, ঠিকাদারি, চালের ব্যবসা, কত কী। আবার কেউ কেউ মাস্টারির মতো চাকরিবাকরিও পেয়ে গেল। গ্রামে শুধু চাষবাস করে পেটপালা লোক একেবারে কমে গেল। এক অংশ যারা মজুর ছিল, মজুরই থেকে গেল। সামান্য যা ছিটেফোঁটা জমি-জায়গা পেয়েছিল, তা দিয়ে খাঁটি চাষি হওয়া যায় না। আবার যাদের জমি ছিল তারাও শুধু চাষের উপর দাঁড়িয়ে রইল না। তার সঙ্গে নানা কিছু করতে লাগল, যার মধ্যে একটা হল পার্টি। প্রথম প্রথম আমরা পার্টির ধার ধারতাম না। চাঁদা দিয়ে খালাস। কিন্তু যুগ বদলায়। এখন শুধু টাকা থাকলে সব কেনা যায় না, পার্টির ক্ষমতাটা দরকার। আর সেই ক্ষমতা থাকলে টাকার আমদানি আটকায় কে? তার মানে টাকা আর পার্টির ক্ষমতা আগে যেটা আলাদা ছিল, এখন একেবারে খাপে খাপে মিশে গেল। বাপ আজ বেঁচে নেই, থাকলে দেখতে পেত, যে ব্যাটাকে সে নটকোনার দোকানটাও ঠিক মতো চালাতে পারবে না বলে সকাল সন্ধ্যা খোঁচা দিত, সে-ই আজ এলাকার মালিক। তার কথায় লোকে ওঠে-বসে। এক সময় যার বাপ বিডিও বা ডিএম-এর পায়ে পড়ত, এখন কত লোক তার পায়ে পড়ছে। আর বাপ যে ব্যাঙ্ককে ভয় পেত, আমি এখন সেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা কামাবার কত রাস্তা বার করে ফেলেছি।
বলেছি তো, এ সুযোগ সবার ভাগ্যে নেই। সবার বাপ তো তার ছেলেকে টাকার সাধনা করতে শেখায়নি। বা শেখাতে পারেনি। যারা পেরেছে তাদের ছেলেরা সুপুত্র। বাপের সাধনা ধরে রেখেছে, তার বাপের, তারও বাপের পারিবারিক ইতিহাস ধরে রেখেছে। সারা মাস, সারা বছর নানান পুজোআচ্চা। বিধর্মী মুসলমান, অজাত-কুজাতের লোকেদের ঘরে উঠতে দেয়নি। তাদের বাচ্চারা গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলে অন্য জাতের ছোঁওয়া বাঁচিয়ে খেতে পারলে খায়, না হলে খাওয়া বারণ। তাদের মেয়েদের ইস্কুলে পাঠানো হয় বটে, কিন্তু দশ-বারো ক্লাস হলেই বিয়ের তোড়জোড়। ছেলেদের জন্য অবশ্য অন্য ব্যবস্থা। কলকাতা, দার্জিলিং, লন্ডন পাঠাবার উদ্যোগ।
নেতাগিরি আর টাকা-করার ডবল ধামাকার চোটে মাঝেমধ্যে, কিংবা প্রায়ই লাঠালাঠি হয়। সে সব আমি করতে যাই না। কেন যাব? লোক আছে, ওরা করবে। বাপের কথাটা আমি একটু বদলে নিয়েছি। মজুরদের নিজেদের মধ্যে এমন ভাবে লড়িয়ে রাখো, যাতে ওরা নিজেদের মধ্যে কথাটুকুও না বলতে পারে। চোখের দিকে যদি তাকাতেই হয়, একে অন্যের চোখে চোখ রাখুক। আমার দিকে তাকাবার সময় হলেই সামর্থ্য হবে, তাই সময়টাও দিই না। শাসন ছাড়া টাকা হবে না, টাকা ছাড়া শাসন চলবে না, এইটাই মন্ত্র। সেই মন্ত্রেই পার্টি। আজ এই পার্টি, তো কাল ওই পার্টি। যেখানে গেলে সুবিধা হবে সেখানে যাব। বড় ক্ষমতাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে যাব— বাপ শিখিয়ে গেছে— ছোটদের সব সময় পায়ের তলায় রাখব, যেমন করে রাখতে হয় নিজের ঘরের মেয়ে-বউদের। নীতি, আদর্শ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ— ও সব কলকাতা শহরের জন্য থাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy