ছবি সংগৃহীত
গণতন্ত্রের পরিসরে বিরোধীদের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, জনগণ তাহা প্রায়শই বুঝিতে পারেন না। তাহা সাধারণ মানুষের অক্ষমতা নহে, বিরোধী রাজনীতির ব্যর্থতা। সম্প্রতি কংগ্রেসের শীর্ষ স্তরের নেতারা ফের আবেদন করিলেন, যেন রাহুল গাঁধী দলের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন— নচেৎ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়িয়া তোলা যাইতেছে না। কোনও দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কোন পথ চলিবে, তাহা নিতান্তই সেই দলের বিবেচ্য— কিন্তু এক্ষণে স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, গত কয়েক মাসে যদি একটিমাত্র বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ধারাবাহিক ভাবে যুক্তিগ্রাহ্য বিরোধিতা করিতে শোনা গিয়া থাকে, তবে তাহা রাহুল গাঁধীর। সত্য বলিতে, তাঁহাকে বাদ রাখিলে গত কয়েক মাসে ক্ষীণকণ্ঠ বামপন্থী দলগুলি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতীত আর কোনও বিরোধী শক্তি চোখে পড়িয়াছে বলিয়া স্মরণ করা মুশকিল। ঘোষিত ভাবে বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মৌন বিশেষ ইঙ্গিতবাহী কি না, কেহ সেই প্রশ্নও করিতে পারেন। কিন্তু, সেই প্রসঙ্গে না ঢুকিয়াও বলা সম্ভব যে, অধিকাংশ বিরোধী দলই নিজেদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।
সেই ব্যর্থতা কতখানি গুরুতর, সাম্প্রতিক অতীতেই তাহার বহু প্রমাণ। যখন সংসদ বন্ধ, তখন কেন্দ্রীয় সরকার যে ভঙ্গিতে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ করিল, তাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি সম্ভ্রমহীনতা স্পষ্ট। যে নীতি দেশের প্রতিটি রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করিবে, সেই নীতিটি প্রকাশিত হইল রাজ্যগুলির সহিত আলোচনা ছাড়াই, সংসদের পথ এড়াইয়াই। গত বৎসর যখন খসড়া শিক্ষানীতি প্রকাশিত হইয়াছিল, তখন গোটা দেশ জুড়িয়া যে সমালোচনা এবং বিকল্প ভাবনা শোনা গিয়াছিল, তাহার প্রায় কোনও ছাপ প্রকাশিত নীতিতে পড়ে নাই। অর্থাৎ, জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিল। তাহার সুতীব্র প্রতিবাদ করা বিরোধী রাজনীতির আবশ্যিক কর্তব্য ছিল, গণতন্ত্রের স্বার্থে, নাগরিকদের স্বার্থে— কিন্তু কোথায় সেই প্রতিবাদ? আরও একটি উদাহরণ: কাশ্মীর। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করিয়া সরকার জানাইল, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও শিক্ষাবিদ সৈফুদ্দিন সোজ়কে আদৌ গৃহবন্দি করা হয় নাই। মামলা খারিজ হইয়া গেল। এবং, তাহার পরের দিনই দেখা গেল, শ্রীসোজ়কে সাংবাদিকদের সহিত কথা বলিতে হইতেছে প্রাচীরের উপর হইতে উঁকি দিয়া, প্রহরীদের সহিত তর্ক করিয়া। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে সরকারি পক্ষ যাহা বলিয়াছে তাহার নাম— মিথ্যা। ইহার পরও বিরোধীরা রা কাড়িবে না? সর্বোচ্চ আদালতে সরকারপক্ষের এই মিথ্যাচারের সাহস কি তৈরি করিয়া দেয় নাই বিরোধীদের এই নিষ্ক্রিয়তা?
প্রশ্নটি কোনও এক বিশেষ নেতার গৃহবন্দিত্বের নহে— প্রশ্ন বিরোধী স্বরের স্বাধীনতার। তাহা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। গত এক বৎসরে কাশ্মীরে যে গণতন্ত্রের ভড়ংটুকুও নাই, তাহার প্রতিবাদ দূরের কথা, দেশের বিরোধী রাজনীতিকরা তাহা লক্ষ করিতেছেন কি না, তাহাও অজানা। এই নিষ্ক্রিয়তা আলস্যজাত, না কি তাহার পিছনে গূঢ়তর কারণ আছে, সেই আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। নিজেদের গণতান্ত্রিক কর্তব্য পালন না করিয়া তাঁহারা সেই নাগরিক বিশ্বাসের অবমাননা করিতেছেন, যাঁহারা ভোটিং মেশিনে তাঁহাদের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এমনকি, যাঁহারা বিজেপি-কে ভোট দিয়াছিলেন, বিরোধীদের নিষ্ক্রিয়তা প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহাদেরও ক্ষতি করিতেছে। অগণতান্ত্রিকতা যখন স্বৈরাচারের রূপ পরিগ্রহ করে, তখন তাহা আর চাল-কাঁকর বাছে না— শিরদাঁড়ার চিহ্নমাত্র দেখিলেই তাহা গুঁড়াইয়া দিতে চাহে। স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতা বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করা, এবং তাহা হইতে নাগরিককে রক্ষা করিবার দায়িত্ব বিরোধীদেরই নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy