মুখ্যমন্ত্রী আসিয়া উদ্বোধন করিয়া গিয়াছেন। ঝাঁ চকচকে ভবন, ততোধিক উজ্জ্বল সাইনবোর্ড, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি— সবই আছে। যাহা নাই, তাহার নাম রোগীর প্রতি সহমর্মিতা। সংবাদে প্রকাশ, কলিকাতার একটি সরকারি হাসপাতালের নবনির্মিত ট্রমা কেয়ার সেন্টারে গুরুতর আহত রোগীকে লইয়া গেলেও কর্মরত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্য পাওয়া যায় না। স্ট্রেচারের বন্দোবস্ত হইতে শুরু করিয়া এক্স-রে করাইতে লইয়া যাওয়া, এমনকী রোগীকে পাশ ফিরাইয়া দেওয়া, স্ট্রেচারে উঠানো-নামানো, সব দায়িত্বই পরিজনদের। একটির বেশি দুইটি প্রশ্ন করিলে যে উত্তর শুনিতে হয়, তাহা— হাসপাতাল দূরস্থান— সভ্য সমাজের কোনও পরিসরেই উচ্চারিত হইবার কথা নহে। অথচ ইহাই এ রাজ্যে ‘স্বাভাবিক’। কেবল হাসপাতালে নহে, সরকারি স্কুল হইতে হরেক প্রশাসনিক দপ্তর, থানা, সর্বত্র। পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতাই হইল, সরকারি জায়গায় পরিষেবা যদিও বা বিঘৎপরিমাণ পাওয়া যায়, সহমর্মিতা কোথাও মিলে না। বরং, না চাহিতেই মিলে বিপুল অবজ্ঞা, দুর্বিনয়, হয়রানি, অপমান। কর্তব্যসম্পাদন নহে, অধিকাংশ সরকারি কর্মীই যেন পরিষেবাপ্রার্থীকে দয়া করেন। সম্পর্কটি যেন দাতা ও গ্রহীতার— তাহার পরতে পরতে উচ্চাবচতা, অনুগ্রহের অহংকার।
কেন এই হাল? একটি কারণ অনুমান করা চলে। সরকারি ক্ষেত্রে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের ন্যায় পরিষেবা নিখরচায় মিলে। সেই পরিষেবার অধিকাংশ প্রাপক গরিব মানুষ। মধ্যবিত্তও নেহাত বেকায়দায় না পড়িলে আজ আর সরকারি হাসপাতাল বা স্কুলের চৌকাঠ পার হন না। গরিবকে অবজ্ঞা করিবার, অপমান করিবার ‘অধিকার’টি এই সমাজে স্বতঃসিদ্ধ বলিয়া গণ্য। তাহার উপর সরকারি কর্মীরা জানেন, গরিব মানুষগুলি যে পরিষেবা লইতে আসিয়াছেন, তাহার জন্য তাঁহারা টাকা দিবেন না। হয়তো তাঁহারা ধরিয়া লন, এই নিখরচার পরিষেবাটি প্রকৃত প্রস্তাবে অনুগ্রহ, এবং সরকারের প্রতিভূ হওয়ার সুবাদে অনুগ্রহটি তাঁহারাই করিতেছেন। ভিক্ষার চাল বাছা চলে না। অতএব, এক সিকে পরিষেবার চালের সহিত বারো আনা অপমানের কাঁকর দেওয়াকেই তাঁহারা যথেষ্ট জ্ঞান করিয়া থাকেন। নাচার গরিবের পক্ষে সেই কাঁক়র হজম করা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই।
আর জি করের ট্রমা কেয়ারের কর্মীদের যেমন বুঝিতে হইবে যে রোগীরা নিজেদের অধিকারবলে হাসপাতালে পরিষেবা লইতে আসেন, দয়ার দান লইতে নহে, মিড-ডে মিলের খাবার বণ্টন করিতে বসা শিক্ষককেও তেমনই বুঝিতে হইবে, প্রতি দিন দুপুরের খাবারটি প্রত্যেক শিশুর অধিকার, মাস্টারমহাশয়ের বদান্যতা নহে। মধ্যবিত্ত কবে গরিবকে সম-মানুষ জ্ঞান করিবে, তাহার অপেক্ষায় বসিয়া থাকা চলে না। সরকারি পরিষেবায় যথাযথ স্বাস্থ্য বা শিক্ষা পরিষেবা প্রদান করা কর্মীদের যতখানি দায়িত্ব, পরিষেবাগ্রহীতার সম্মান বজায় রাখাও যে ঠিক ততখানিই, এই কথাটি তাঁহাদের বুঝাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। তাঁহারা দয়া করিতে বসেন নাই, কাজ করিতে বসিয়াছেন। সভ্য সমাজ যে গুণমানের পরিষেবা প্রত্যাশা করে, সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে প্রত্যেককে তাহা দেওয়াই কর্তব্য। কর্মীদের এই কথাটি শিখাইতে না পারিলে অত্যাধুনিক যন্ত্র বা চকচকে নামফলক অর্থহীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy