ফাইল ছবি।
নাট্যশালাতেও একটি শৃঙ্খলা থাকে। কোন দৃশ্যের পর কোনটি অভিনীত হইবে, অনুষ্ঠানের ক্রম কী হইবে, তাহা পূর্বনির্দিষ্ট হয়। এবং, কোনও মনসবদার, তাহা তিনি যত বড় মাপের কর্তাই হউন না কেন, নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে সেই ক্রমটিকে ঘাঁটিয়া ফেলিতে পারেন না। অতএব, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নাট্যশালা নহে। কারণ, পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ইচ্ছায় বিধানসভায় পূর্বঘোষিত বিল পেশ করিবার সিদ্ধান্তটি নাকচ হইয়া যায়। বিভাগীয় মন্ত্রী বিল পেশ করিতে প্রস্তুত ছিলেন, বিরোধীরাও আলোচনার জন্য তৈরি ছিলেন, স্পিকারের সিদ্ধান্ত ছিল বিল পেশ করিবার। কিন্তু, পার্থবাবুকে নড়াইতে পারেন, সাধ্য কাহার। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় বিধানসভা চালাইবার জন্যও তিনি টাকা দেন কি না, পার্থবাবু বলেন নাই। কিন্তু, তাঁহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অতিক্রম করিয়া যে খাস বিধানসভাতেও কাজ হইবে না, তিনি বুঝাইয়া দিলেন। অভিযোগ উঠিতেছে, মাসাধিক কাল পূর্বে দিন ক্ষণ নির্দিষ্ট করা হইলেও বিধানসভায় প্রতি দিনই কর্মসূচি লইয়া অনিশ্চয়তা চলিতেছে। আইনসভার নিজস্ব রীতিনীতিকে শ্রদ্ধা করিতে শেখা যে পরিষদীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, মন্ত্রিবর দৃশ্যত তাহা ভুলিয়াছেন। সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রথাটিকেও তাঁহারা আদিগঙ্গায় ভাসাইয়া দিলেন। এই রাজ্যে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শিরদাঁড়া ভাঙিয়া যাইতেছে। বিধানসভাও যদি সেই তালিকায় নাম লিখায়, তবে তাহা অতি দুর্ভাগ্যের।
বিল পেশ করা হইবে কি না, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ বিলক্ষণ আছে। বিরোধীদের সহিত, এমনকি স্পিকারের সহিতও মন্ত্রিমহোদয়ের মত না-ই মিলিতে পারে। কিন্তু, তাহার পরিণতি বিবাদ নহে, চাপাইয়া দেওয়া নহে— আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানসূত্র খুঁজিয়া লওয়া। পার্থবাবু তাহাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। শুধু বিধানসভায় নহে, সর্বত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া লইয়া যে অহেতুক বিতর্কটি তৈরি হইল, এবং বিপুল আকার ধারণ করিল, তাহারও মূলে রহিয়াছে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাইবার কাজে পার্থবাবুর বিপুল ব্যর্থতা। দৃশ্যত, তাঁহার নিকট নিজের গুরুত্ব এমনই আকাশছোঁয়া, নিজের অহং এমনই প্রবল, নিজের ব্যক্তিত্ব এতটাই ওজনদার যে, অন্য কোনও মতকে সূচ্যগ্র পরিমাণ জায়গা ছাড়িতেও তিনি নারাজ। নেতা হইবার প্রথম শর্ত অহংকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে উপনীত হওয়া। পার্থবাবু প্রতি ক্ষেত্রেই বিপরীতগামী। যেখানে কোনও সমস্যাই নাই, সেখানেও তাঁহার অহং অনতিক্রম্য সমস্যার জন্ম দিতেছে। এমন এক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্বে রাখা কতখানি যুক্তিযুক্ত, মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
তবে, ভাবিবার আরও কথা তাঁহার জন্য আছে। নেতৃত্বের চূড়ান্ত দায়টি প্রশ্নাতীত ভাবেই তাঁহার উপর ন্যস্ত। মতানৈক্য যাহাতে সমস্যা না হইয়া দাঁড়ায়, এবং সমস্যা যাহাতে সঙ্কট না হইয়া উঠে, তাহা নিশ্চিত করাই মুখ্যমন্ত্রীর কাজ। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম বলিতেছে, প্রাথমিক আলোচনাতেই যে মতানৈক্য কাটিয়া যাওয়ার কথা, সামান্য উদ্যোগেই যে সমস্যা মিটিবার কথা, তাহার প্রতিটিতেই শেষ অবধি অচলাবস্থা তৈরি হইতেছে। যাদবপুর হউক বা কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ, রফাসূত্র খুঁজিতে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যর্থতা প্রকট। বিধানসভাতেও এমনই পরিস্থিতি তৈরি হইল যে স্বয়ং স্পিকার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছেন। ইহা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। ক্ষেত্র পৃথক, ঘটনাক্রম পৃথক, কিন্তু ব্যর্থতার চরিত্রটি অবিকল এক রকম। মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখুন, তাঁহার নেতৃত্বে কোথায় ফাঁক থাকিয়া যাইতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy