Advertisement
E-Paper

অনুমান দিয়ে বিষয়টি বোঝা অসম্ভব

কলকাতা শহরের চার গুণেরও বেশি জায়গা জুড়ে ঘটেছে এ বারের নেপালের ভূমিকম্প। গত আট দশকে এমন ভূকম্পন নেপাল দেখেনি। পশ্চিমবঙ্গও এতটা ভয় আগে পায়নি।এই লেখা শুরু করা পর্যন্ত নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক সংস্থার হিসেব মতো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেপালের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের থেকে বহুগুণ বেশি। ভূমিকম্পের উৎসস্থল কাঠমান্ডুর আশি কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে লামজুঙের কাছে পনেরো থেকে কুড়ি কিলোমিটার গভীরে। ৭.৮ মাত্রার এমন ভূমিকম্প নেপালে গত আট দশকে হয়নি।

সুপ্রিয় মিত্র ও অনিন্দ্য সরকার

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০০:০৩
ধ্বংসের মুখোমুখি। কাঠমান্ডুর উত্তরে সাথিঘর গ্রাম, ২৯ এপ্রিল। ছবি: এএফপি

ধ্বংসের মুখোমুখি। কাঠমান্ডুর উত্তরে সাথিঘর গ্রাম, ২৯ এপ্রিল। ছবি: এএফপি

এই লেখা শুরু করা পর্যন্ত নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক সংস্থার হিসেব মতো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেপালের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের থেকে বহুগুণ বেশি। ভূমিকম্পের উৎসস্থল কাঠমান্ডুর আশি কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে লামজুঙের কাছে পনেরো থেকে কুড়ি কিলোমিটার গভীরে। ৭.৮ মাত্রার এমন ভূমিকম্প নেপালে গত আট দশকে হয়নি। ভূমিকম্পের দুই দিন পরেও অন্তত পঁয়তাল্লিশটি ৪ থেকে ৬ মাত্রার কম্পন বা আফটারশক নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন শহরে আতঙ্ক ও ত্রাস তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে। গুজব ছড়াচ্ছে দ্রুত। উত্তরবঙ্গ তো বটেই, কলকাতা ও তার কাছেপিঠেও নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কিছু ঘরবাড়ি। কলকাতা নাকি বসে আছে এমন এক চ্যুতি বা ফল্ট-এর ওপর যে সামান্য কম্পনেও ধূলিসাৎ হতে পারে এই মহানগরী। সম্ভবত এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর নাগরিক বা বহুতলবাসীর মনে তৈরি হয়েছে অজানা আতঙ্ক।

নেপথ্য ছবি

গত ২০০ বছরে হিমালয় পর্বতমালার অর্ধেক বিস্তৃতি জুড়ে অন্তত সাতটি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছে। এগুলির মধ্যে তিনটিরই অবস্থান নেপালে (১৮০৩, ১৮৩৩ ও ১৯৩৪ যথাক্রমে পশ্চিম, মধ্য নেপাল ও বিহার-নেপাল অঞ্চলে)। এ ছাড়া ১৮৯৭ সালে শিলং, ১৯০৫ এ কাঙরা, ১৯৫০ এ আসাম এবং ২০০৫ এ কাশ্মীরে ঘটে বিধ্বংসী ভূমিকম্প। আরও পুরনো ভূমিকম্পের ইতিহাস জানার জন্যে ভূবিজ্ঞানীরা সাধারণত পুরা-ভূকম্পন বিদ্যা বা প্যালিও-সিস্্মলজির সাহায্য নেন। ভূকম্পনের সময় জলের চাপ বৃদ্ধি কারণে মাটির নীচে পাললিক শিলাস্তরের তরলীকরণ বা লিকুইফ্যাকশন ও তজ্জনিত বিকৃতির প্রমাণ সংগ্রহ করেন। শিলাস্তরের ভিতরে জমে থাকা জৈব পদার্থের রেডিওকার্বন ডেটিং বা শিলাস্তরের মহাজাগতিক বা কসমোজেনিক আইসোটোপের সাহায্যে নির্ধারিত হয় শিলাস্তরের বা ভুমিকম্পের বয়স। এভাবেই জানা গেছে, ১১২৫ সালে পূর্ব নেপাল-বিহারে, ১৪০০ সালে পশ্চিম নেপাল, ১৫০৫ সালে মধ্য নেপাল এবং ১৫৫৫ সালে কাশ্মীরে ঘটেছিল তীব্র ভূকম্পন। বস্তুত এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই গত মার্চ মাসে এক গবেষণাপত্রে তিরুবনন্তপুরমের ভূবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের বিজ্ঞানী সি পি রাজেন্দ্রন মধ্য নেপাল অঞ্চলে তীব্র ভূকম্পনের আভাস দেন। কিন্তু এই পূর্বাভাস আদৌ দেওয়া সম্ভব কি না তা আলোচনা করার আগে দেখে নেওয়া যাক ২৫ এপ্রিলের এই ভূমিকম্পের কারণটা ঠিক কী ছিল।

হিমালয় আসলে এক তরুণ ও সক্রিয় ভঙ্গিল পর্বতমালা, যার সৃষ্টি হয়েছে গত পাঁচ কোটি বছর ধরে ভারতীয় ও ইউরেশিয়া প্লেটের অভিসৃতি ও সংযুক্তির ফলে। বর্তমানে ভারতীয় প্লেট বছরে ২ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান বা তিব্বতীয় প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। সাধারণ দৃষ্টিতে এই হার যদিও খুব কম, বহু দশক ধরে চলতে থাকায় এই ঘর্ষণ বা স্ট্রেসের ফলে উৎপন্ন শক্তি মুহূর্তের মধ্যে নির্গত হয় ভূকম্পন হিসেবে। এই শক্তিই পরিবর্তিত হয় ইলাস্টিক তরঙ্গে। এর ফলে উদ্ভূত পৃষ্ঠতরঙ্গ মাটির ওপর কম্পন হিসেবে প্রসারিত হয়। ধ্বংস করে দেয় শহর ও জনপদ। স্বভাবতই শক্তির এই সঞ্চয় ও তার নির্গমন হয় এক আবর্তিত গতিতে। যেমন, ১৯৩৪-এর একাশি বছর বাদে ২০১৫ সালে। ভূকম্পনের ফলে উৎপন্ন শক্তি মাটির বহু গভীরে শিলাস্তরে ভাঙ্গন ধরায়, সৃষ্টি করে এক বা একাধিক চ্যুতি। সমগ্র হিমালয় পর্বতমালায় রয়েছে এমন একাধিক চ্যুতি, দক্ষিণ থেকে উত্তরে যথাক্রমে হিমালয়ান ফ্রন্টাল থ্রাস্ট, মেন বাউন্ডারি থ্রাস্ট ও সুউচ্চ হিমালয় অঞ্চলের মেন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট, যেগুলি গিয়ে মিশেছে বহু গভীরের মেন হিমালয়ান থ্রাস্ট-এর সাথে। সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী কখনো ফ্রন্টাল বা কখনও মেন বাউন্ডারি থ্রাস্ট-এ ঘটা চ্যুতিকে এই ভুমিকম্পের কারণ বলে অনুমান করা হয়েছে। ভূমিকম্প চলাকালীন এবং পরবর্তী তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আসলে পিছলে গিয়েছে মেন হিমালয়ান থ্রাস্ট-এর এক অংশ। এই থ্রাস্ট-এর নীচে ঢুকে যাচ্ছে ভারতীয় প্লেট আর ওপরে চড়ে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। উত্তরের দিকে যেখানে এই থ্রাস্ট ঢুকে গেছে অনেক গভীরে, প্রায় স্থিতিস্থাপক ভারতীয় প্লেট সেখানে ঢুকছে অতি ধীরে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এবং কোনও ভুকম্পন সৃষ্টি না করেই। দক্ষিণে, যেখানে এটি অগভীর (যেমন নেপালের হিমালয় পাদদেশ অঞ্চল) সেখানে সঞ্চিত শক্তি তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা ও ভঙ্গুর শিলাস্তরে জন্ম দেয় চ্যুতির। আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ ভূকম্পন সংস্থা ও আই আই এস ই আর কলকাতা ভূকম্পন মানমন্দিরে বিশ্লেষিত তথ্য অনুযায়ী ২৫ তারিখের প্রধান ভূকম্পন হয় মাটির ১৭ কিলোমিটার গভীরে সৃষ্ট উত্তরপূর্বের দিকে ৫ ডিগ্রি নত এক চ্যুতি থেকে। অন্তত ১৫০ কিলোমিটার লম্বা ও ৫৫ কিলোমিটার চওড়া এই চ্যুতির স্খলন হয়েছে চার মিটারের ওপর, যার ফলে গোটা নেপাল হিমালয় দক্ষিণ পূর্ব দিকে ভারতীয় প্লেটের দিকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। চ্যুতির মোট প্রভাবিত ক্ষেত্র ৮০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি, কলকাতা শহরের চার গুণেরও বেশি জায়গা জুড়ে আর সেটাই কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে কাঠমান্ডু থেকে কলকাতা-দিল্লি। কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ হিমালয়ের ভুকম্পনে এত সন্ত্রস্ত কখনো হয়নি যেমনটি হয়েছে ২৫ তারিখ সকালে। ক্রমশ বাড়তে থাকা বহুতল আর ভেসে আসা অসংখ্য মতামত আমজনতাকে ভাবিয়ে তুলছে রাজারহাটে যে ফ্ল্যাটটা বুক করা হয়েছে তা বাতিল করা উচিত কিনা !

কতটা নিরাপদ আমরা?

উত্তরবঙ্গ তো বটেই, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টিরও ওতপ্রোত সম্পর্ক হিমালয়ের বিবর্তনের সাথে। রাজ্যের এই অংশ বা বেঙ্গল বেসিনের সৃষ্টিই হয়েছে হিমালয়ের উত্থান ও তৎসংশ্লিষ্ট অববাহিকা অঞ্চলের অবনমনের ফলে। মধ্য ইয়োসিন যুগ বা প্রায় ৪ কোটি বছর থেকেই হিমালয়ের নদীবাহিত পলি জমেছে এখানে। বিগত বরফ যুগ বা আঠেরো হাজার বছরের পলির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সমুদ্রতলের ও নদীর গতি ও প্রকৃতির। কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় মাটির নীচে যেমন রয়েছে বালির বিভিন্ন আকারের পুরা-নদী খাত, তেমনই রয়েছে কাদামাটির প্রাচীন বন্যাসৃষ্ট সমতল। এই সময়কার পলির ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতা শহর, তার চরিত্র জটিল এবং মোটেই এক রকমের নয়। এই অঞ্চলের পূর্বে রয়েছে চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পর্বতশ্রেণি, পশ্চিম দিয়ে চলে গেছে কলকাতা-ময়মনসিংহ হিঞ্জ জোন যার ভূকম্পীয় সম্ভাব্যতা (আর্থকোয়েক পোটেনশিয়াল) সম্বন্ধে তেমন বিশেষ কিছু জানা নেই। এই হিঞ্জ জোনটির নিচে আছে একটি গ্র্যাভিটি হাই, যা কম ঘনত্বের ভারতীয় স্থলভূমির ভূস্তরকে পূর্বের উচ্চ ঘনত্বের সামুদ্রিক ভূস্তর থেকে আলাদা করে। অর্থাৎ এটা কোনও চ্যুতি নয়। কাজেই ভবিষ্যৎ ভূমিকম্পের কারণ হিসাবে এর ভূমিকা নেহাতই অনুমান ছাড়া কিছু নয়। বেঙ্গল বেসিনের চারিদিকে কিন্তু ছড়িয়ে রয়েছে বড় আকারের বেশ কয়েকটি চ্যুতি, যেমন দেবগ্রাম-বোগরা ফল্ট, চিটাগাং-কক্সবাজার ফল্ট। সমস্যা হল, এই সমস্ত চ্যুতির সম্বন্ধে আমাদের তথ্য প্রায় নেই বললেই চলে। যা আছে তা শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্যবিবর্জিত অনুমান। অনুমান দিয়ে আর যাই হোক, ভূমিকম্পের মতো জটিল প্রাকৃতিক বিষয় বোঝা অসম্ভব।

সুপ্রিয়বাবু আইআইএসইআর, কলকাতা-য় ভূতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক,

ভূকম্পন মানমন্দির-এর প্রধান। অনিন্দ্যবাবু আইআইটি খড়্গপুর-এ ভূতত্ত্ব ও

ভূপদার্থ বিভাগে শিক্ষক, ন্যাশনাল আইসোটোপ ফেসিলিটি’র প্রধান

(চলবে)

Supriyo mitra anindya sarkar geologist supriyo mitra on earthquake geophysicist anindya sarkar on earthquake kolkata seismic zone post earthqauke analysis abp post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy