Advertisement
E-Paper

লোকালয়ে কেন দলমার দামাল, খোঁজে দুই পড়ুয়া

ঝাড়গ্রামে বছরে গড়ে ১০ জনের মৃত্যু হয় হাতির হামলায়। হাঁস, মুরগি নিয়ে পালায় বুনো জন্তু। কেন বন্যপ্রাণ-মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে? দুই পড়ুয়ার গবেষণাপত্রে উঁকি দিলেন কিংশুক গুপ্তহাতি এবং মানুষের দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশাসন ভাবে। বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা মানুষজন ভাবেন। ভাবেন গ্রামবাসীরাও। এখন পড়ুয়ারারও ভাবছে।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:১৭
 মূর্তিমান: গড়বেতার পানশিউলিতে হাতির দল। (ইনসেটে) সৌমিত্র এবং বকুল। নিজস্ব চিত্র

মূর্তিমান: গড়বেতার পানশিউলিতে হাতির দল। (ইনসেটে) সৌমিত্র এবং বকুল। নিজস্ব চিত্র

এলাকা কাঁপে বিস্ফোরণে। ভয় পায় হাতির দল। ভয়েই তারা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। আবার বেশ কিছু জায়গায় জঙ্গলও কমছে। পেটে টান। পেট ভরাতেও তারা ঢুকে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়। মাঠে ফসল না থাকলে হানা দেয় গৃহস্থের বাড়িতে। কখনও ঘটে যায় প্রাণহানিও।

হাতি এবং মানুষের দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশাসন ভাবে। বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা মানুষজন ভাবেন। ভাবেন গ্রামবাসীরাও। এখন পড়ুয়ারারও ভাবছে। ভেবেছিল সৌমিত্র দাস আর বকুল পাত্র। সৌমিত্র নবম শ্রেণির ছাত্র। বকুল পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। দু’জনেই ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর-১ ব্লকের দহিজুড়ি মহাত্মা বিদ্যাপীঠের ছাত্র। তারা যৌথ ভাবে ‘বন্যপ্রাণ ও মানব সংঘাত’ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছে।

হঠাৎ ভাবনায় কি কাজ শুরু? তা নয়। স্কুল চত্বরে দাঁড়িয়ে বলছিল সৌমিত্র আর বকুল। তাদের বাড়ি দহিজুড়িতে। সেখানে হাতির তেমন উপদ্রব নেই। সৌমিত্র জানায়, এলাকায় বন্যপ্রাণ ও মানুষের মধ্যে সংঘাত দিন দিন বাড়ছে। খবরের কাগজ বা টিভি খুললেই, নিয়মিত হাতির হামলার খবর মেলে। এখন তো ‌নেকড়ে, হায়না, হরিণও ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এর কারণ কী? স্কুলে তো নানা এখন প্রজেক্ট করতে হয়। সৌমিত্র আর বকুল বন্যপ্রাণ এবং মানুষের সঙ্গে সংঘাতের বিষয়টিই প্রজেক্ট হিসেবে বেছে নেয়।

কাজ শুরু করে দুই পড়ুয়া। জঙ্গল এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তারা কথা বলে। বনাধিকারিক, বিভিন্ন বনাঞ্চল (রেঞ্জ) এবং বনক্ষেত্রের (বিট) বনকর্মীদের সঙ্গে দেখা করে বন ও বন্যপ্রাণ বিষয়ে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করে। দুই পড়ুয়ার গবেষণার তথ্য কী বলছে? বন দফতরের দাবি অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ঝাড়গ্রাম জেলায় জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ছে। সেই কারণেই এই এলাকায় নেকড়ে, হায়না, খেঁকশিয়াল, বাঘরোল, বুনোশুয়োর, রক পাইথনের দেখা বেশি করে মিলছে। এখন তো ঝাড়গ্রাম শহরের কাছে বৃন্দাবনপুরের জঙ্গল রাস্তায় যাওয়ার সময় প্রায়ই নেকড়েদের দেখা মেলে। আর হাতি তো সারা বছর ঝাড়গ্রাম জেলার প্রায় সর্বত্রই মাঝে মাঝেই দেখতে পাওয়া যায়। ঝাড়গ্রামের গড়শালবনি কিংবা নয়াগ্রামের তপোবনের জঙ্গলে বছরের বেশিরভাগ সময়ই রেসিডেন্ট হাতিরা থাকে। বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা-কাঁকড়াঝোর ট্রেকিং রুটটি গিয়েছে ঘন জঙ্গল চিরে। বিকেল হলেই ওই জঙ্গলপথে হাতিরা বেরিয়ে পড়ে।

কিন্তু লোকালয়েও তো হাতিদের হানাদারি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন খেটেখাওয়া মানুষেরা। হাতি দেখলে রে-রে করে তেড়ে যান গ্রামবাসী। তাড়া খেয়ে হাতিরাও আরও ক্ষিপ্ত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি করে। পড়ুয়াদের গবেষণা বলছে, ক্রমাগত তাড়া খেতে খেতে হাতিরাও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। পালের শাবকেরাও শিখে যায়, তাড়া খেয়েই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে খুঁজে নিতে হবে বেঁচে থাকার রসদ। ঝাড়গ্রাম শহরে গত দু’দশকে ৯ বার রেসিডেন্ট হাতি ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।

কেন বন্যপ্রাণিরা লোকালয়ে চলে আসছে। পড়ুয়াদের পর্যবেক্ষণ, আগে যে এলাকা দিয়ে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে হাতিরা যাতায়াত করত, সেই এলাকাগুলোয় জনবসতির ভারে জঙ্গল পাতলা হয়ে গিয়েছে। তৈরি হয়ে গিয়েছে রাস্তাঘাট। জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ক সম্প্রসারণের জন্য অনেক গাছ কাটতে হয়েছে। জঙ্গলে হাতির উপযোগী খাবার নেই। তাই হাতিরাও চিরাচরিত পশুখাদ্যের বদলে মাঠের কিংবা গৃহস্থের গোলার ধান, মাঠের আখ, আনাজ খাচ্ছে। ঘর ভেঙে মজুদ আনাজ চাল-ধান লুঠ করছে। আবার হাঁড়িয়ার গন্ধেও গ্রামে হানা দিচ্ছে হাতিরা। বছর বছর হাতিরা সংখ্যায় বাড়ছে। হাতির হামলায় প্রাণহানি, ফস‌ল ও সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের জন্য বন দফতরকে ৬-৭ কোটি টাকা প্রতি বছরে খরচ করতে হচ্ছে। প্রতি বছর হাতির হানায় শুধু ঝাড়গ্রামেই গড়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। হুলাপার্টির জন্য বন দফতরকে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়।

পড়ুয়ারা জানাচ্ছে, জনবসতি বাড়ার চাপে বন্যপ্রাণির চেনা বনাঞ্চলের চরিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে। সেই কারণে মাংসাশী প্রাণিরাও লোকালয়ে ঢুকে হাঁস, মুরগি, ছাগল নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। পড়ুয়াদের গবেষণা বলছে, মাত্রাতিরিক্ত গাছ কেটে রাস্তা, চাষাবাদ ও নগরায়নের ফলে হাতিদের স্বাভাবিক করিডরগুলি নষ্ট হচ্ছে। হাতিরাও নতুন করিডরের খোঁজে বিভ্রান্ত হয়ে লোকালয়ে ঢুকছে। এবং বিকল্প খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। হাতিদের লোকালয়ে হানাদারি ঠেকাতে বন দফতর পরিখা খনন করেছে, ব্যাটারি-চালিত বিদ্যুৎ বেড়া দিয়েছে। মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে এলাকায় হাতির আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। শস্য আবর্তনের মাধ্যমে, যেমন লঙ্কা চাষ করে হাতিদের চাষের খেত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।

বন্যপ্রাণ ও মানব সংঘাত ঠেকাতে পড়ুয়াদের নিদান, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা এই তিন রাজ্যে হাতির করিডর নির্দিষ্ট করে পরিখা খনন করতে হবে। যাতে হাতিদের স্বাভাবিক এলাকায় কেউ ঢুকতে না পারে। ঝাড়খণ্ডের দলমা পাহাড় এলাকায় হাতির মূল আবাসস্থল। সেখানে খনি-খাদানে বিস্ফোরণের আওয়াজে হাতিরা থাকতে পারছে ন‌া বলেই তারা পরিযায়ী হয়ে ঘোরে। তাই দলমা এলাকায় সমস্ত খনি বন্ধের জন্য ঝাড়খণ্ড সরকারকে উদ্যোগ করতে হবে। জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় আইন করে শিকার উৎসব বন্ধ করা উচিত বলে মনে করে পড়ুয়ারা। হাতি-উপদ্রুত রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা দরকার বলে মত তাদের।

দুই পড়ুয়ার সমাধান সূত্রে সমর্থন রয়েছে ভুক্তভোগীদের। ঝাড়গ্রাম ব্লকের গড়শালবনি অঞ্চলের জঙ্গলেঘেরা জুয়ালভাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে প্রায়ই ঢুকে পড়ে হাতি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্দীপ করণ বলেন, ‘‘হাতির সমস্যা উদ্বেগজনক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। জঙ্গলপথ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় খুবই সতর্ক থাকতে হয়। এখনই সব মহল সচেতন না হলে পরে আর পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।’’

সৌমিত্র-বকুলের গবেষণাপত্র তৈরিতে তত্ত্বাবধান করেছেন তাদের দুই শিক্ষক চন্দন বসাক এবং শ্রীতম মাইতি। সহপাঠীরাও সাহায্য করেছে। ২০১৮ সালের জেলাস্তরের জাতীয় শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসে তাদের গবেষণাপত্রটি প্রশংসিত হয়েছিল। সেটি পরিবেশ দফতরে পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। মহাত্মা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক মৃন্ময় হোতা বলেন, ‘‘বন্যপ্রাণ এবং মানুষের সংঘাতের সম্ভাব্য প্রতিকারের পথ বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে দুই পড়ুয়া। জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় আসছে। ওরা লোকালয়ে আসছে। প্রতিহিংসাও চরিতার্থ করছে।’’

দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পড়ুয়ারাও ভাবছে।

Research Elephants Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy