Advertisement
E-Paper

‘মেয়ে হয়েও’? ‘মেয়ে বলেই’ নয় কেন

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী টিম হান্ট থেকে শুরু করে ভোটজয়ী নরেন্দ্র মোদী, নানা পুরুষ খামখা মেয়েদের ঠেস দিয়ে এটা-সেটা বলছেন। মেয়েদের একটু নিজের মতো সফল হওয়ার সুযোগ দিলে তো সকলেরই ভাল!নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী টিম হান্ট থেকে শুরু করে ভোটজয়ী নরেন্দ্র মোদী, নানা পুরুষ খামখা মেয়েদের ঠেস দিয়ে এটা-সেটা বলছেন। মেয়েদের একটু নিজের মতো সফল হওয়ার সুযোগ দিলে তো সকলেরই ভাল!

শাশ্বতী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০০:০০

একশো বছরের বেশি আগে এই দেশের প্রথম নারী স্নাতক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৬১-১৯২৩) স্নাতকের পর ডাক্তারি পড়ছিলেন, উচ্চবর্গের মানুষদের থেকে পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে চূড়ান্ত হেলাফেলা পেয়েও মাথা উঁচু করে নিজের পেশা চালিয়েছেন, আটটি সন্তানকে মানুষ করেছেন, জাতীয় কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং সূচিশিল্পেও নাম কিনেছিলেন। মেয়ে হয়েও। আমাদের সমতার ভাবনার পূর্বনারী মার্কিনি লুক্রেশিয়া মট (১৭৯৩-১৮৮০) ছ’টি বা এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন (১৮১৫-১৯০২) সাতটি সন্তানকে মানুষ করেও, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে ঘুরে বেড়িয়ে মেয়েদের আর কালো মানুষদের ভোটের অধিকার ও দাসপ্রথার অবসানের কথা বলেছেন। মেয়ে হয়েও।

নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় তাঁর বক্তৃতায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে গিয়ে ‘মেয়ে হয়েও জঙ্গিদমনে জঙ্গি মনোভাব নিতে’ পেরেছেন বলে বাড়তি সার্টিফিকেট কেন দিলেন, তিনিই জানেন। মেয়ে হলে কি জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে, সুশাসনের ক্ষেত্রে কঠোর আর দক্ষ প্রশাসক হওয়া যায় না? অসুবিধে কোথায়? বরং সারা পৃথিবীতেই তো প্রমাণিত যে, বাইরের পরিসরে মেয়েরা তিন গুণ কাজ করলে তবে পুরুষের সমান স্বীকৃতি মেলে! তিনি একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে জঙ্গিদমনে কঠোর মনোভাব নিতে পারবেন, এক জন তাঁর সমকক্ষ মানুষ, শুধু মেয়ে বলেই তাঁর তরফে শিথিলতা প্রত্যাশিত থাকবে? তেমনি নোবেল পুরস্কারবিজয়ী বিজ্ঞানী টিম হান্ট দক্ষিণ কোরিয়ায় বিজ্ঞান সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলে ফেললেন যে, মেয়েরা ল্যাবে থাকলে বড় সমস্যা। হয় তারা প্রেমে পড়বে, নয়তো অন্য পুরুষ বিজ্ঞানীরা তাদের প্রেমে পড়বে, আর সমালোচনা করলে তারা কান্নাকাটি করবে। এ কথা বলার জন্য তিনি পরে ক্ষমা চাইলেও ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল, রয়াল সোসাইটি আর ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের পদগুলি তাঁকে খোয়াতে হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, তিনি মস্করা করছিলেন, বিষয়টা যে এত গুরুত্ব পাবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।

আসলে সমস্যাটা এখানেই। বিজ্ঞান বা রাজনীতির জগৎ, দুটোর কোনওটাই মেয়েদের জন্য ঠিক জায়গা বলে এখনও বহু মানুষ মনে করেন না। তাই এখনও খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত সমান থাকলেও ডক্টরেট ডিগ্রিতে মেয়েরা পিছিয়ে, দশ জনে চার জন। বিশেষত বিজ্ঞান, কারিগরি, প্রযুক্তি আর গণিতে (প্রথম অক্ষরগুলি নিয়ে বলা হচ্ছে ‘স্টেম’) মেয়েরা কেন জনসংখ্যার অনুপাতে নেই, কাজের চাপের ভয়ে তাঁরা আসেন না, না কি কোনও দৃশ্য বা অদৃশ্য বাধা রয়েছে, সে প্রশ্ন বেশ কিছু দিন ধরেই উঠছে। তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মিলিয়ে কর্মীদের মধ্যে ২৭ শতাংশ মেয়ে, কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবায় ৭০ শতাংশ মেয়ে। বাকি মেয়েরা যান কোথায়? এখনও দেশে-বিদেশে মেয়েরা স্টেম-এর অংশ হবে, সেটা ঠিক ‘কুল’ নয়, এমনকী পশ্চিমি দেশেও। তাই এখনও এ সব বিষয়ে মনে দাগ কাটার মতো, মেয়েদের সামনে শৈশব থেকেই বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অনুসরণ করার মতো আদর্শের বড় অভাব। আরও অভাব ঠিক মতো উৎসাহ পাওয়ার। তাই মেয়েদের মধ্যে ‘আমরাও পারি’ এই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না।

গবেষণা বলছে, অচেনা বিষয়ে ট্যালেন্টের থেকে আত্মবিশ্বাস একটি মেয়েকে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজে থাকতে হবে, বিয়ে পিছোবে, পরিবার আর সন্তানকে সময় দেওয়া যাবে না, সময় চাইলে বিজ্ঞানী টিম হান্টের মতো মস্করা উড়ে আসবে— সব মিলিয়ে মেয়েদের জন্য এক প্রতিস্পর্ধী কাজের পরিবেশ। সেখানে আক্ষরিক অর্থেই পুরুষদের প্রাধান্য, যাঁরা বিশ্বাস করেন মেয়েদের দক্ষতা, কাজের প্রতি গুরুত্ব প্রদান ছেলেদের মতো নয়। এক কালের একটি বিখ্যাত গবেষণায় একই বিষয়ে জন আর জেন নামে একই গবেষণাপত্র পাঠিয়ে দেখা গিয়েছিল, নির্বাচকরা জন নামে পাঠালে অনেক বেশি বার নির্বাচন করেছেন। অনুরূপ এক গবেষণা চালিয়েছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়। ইয়েলের গবেষকরা মেয়েদের নামে ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি চাইলে বেশি নাকচ হয়ে গেছে, ছেলেদের নামে কম। ওই গবেষণা শিক্ষককে এ প্রশ্নও করেছিল: সে গবেষণা করতে চাইলে গাইড হবেন কি? মেয়ে হলে নাকচ, কারণ মেয়েরা আবার মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইবে! এমনকী মেয়ে হলে মাইনেও হবে ২০ শতাংশ কম। অতলান্তিকের অপর পারে ইংল্যান্ডের এক গবেষণা বলছে, অনলাইন কোর্সে একই মানুষ পড়ালেও, যদি পরিচয়ে পুরুষের নাম থাকে, তা হলে তারা ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি রেটিং পায়। এই রেটিং-এর উপরেই কিন্তু এই অনলাইন শিক্ষকদের মজুরি-ভাতা প্রভৃতি নির্ধারিত হয়।

বাস্তবে বহু ক্ষেত্রে ফাটাফাটি মিটিঙে কোনও মেয়ে থাকলে তিনি হবেন একমাত্র মহিলা। এমনকী স্বামী এক পেশায় থাকলেও মায়েরাই বাচ্চাদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবেন, তাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না বলে অবসাদে ভুগবেন মায়েরাই। তার পরেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নিযুক্তির ক্ষেত্রে পুরুষরাই নির্বাচিত হবেন, চাকরি আগে পাকা হবে, প্রকাশনার সংখ্যাতেও থাকবে নারী-পুরুষে বিস্তর ফারাক। এ সবই নাকি মেয়েরা নিজেদের কাজকে গুরুত্ব দেন না বলে। কিন্তু ইয়েলের বা ইংল্যান্ডের গবেষণা তো তা নস্যাৎ করে দিচ্ছে। যেখানে টিম হান্টের মতো মস্করার মেজাজে পুরুষেরা থাকেন, বা ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির আকাশযান রসেটা উৎক্ষেপণের মতো ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রকল্পের অন্যতম বিজ্ঞানী ম্যাট টেলর উত্তেজক ভঙ্গির নগ্নিকাদের ছবি-ছাপা শার্ট পরে আসেন, সেখানে এখনও মেয়েরা পদচারণায় ভীত হতেই পারেন। এখন তো গবেষকরা বলছেন, সমবেতদের মধ্যে অন্তত তিন জনে এক জন মেয়ে না হলে মেয়েদের গলার জোর— অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস আদৌ বাড়ে না। তবে টিম হান্টের মন্তব্যের পর বহু নারী বিজ্ঞানী জানিয়েছেন যে, তাঁদের জীবনে প্রেম এসেছিল ল্যাবরেটরিতে কাজের অবসরেই। এবং একই বিষয়ের হওয়ার ফলে আজীবন কাছাকাছি থাকতে পেরেছেন। তাই ল্যাবে প্রেম ততটা ব্যাঘাত না-ও ঘটাতে পারে।

বিজ্ঞানের মতো রাজনীতিটাও মেয়েদের পক্ষে অ-কাম্য এক পরিসর। সংরক্ষণ দিয়ে পঞ্চায়েত বা পুরসভার মতো নীচের দিকের স্বশাসিত সংস্থায় মেয়েদের প্রবেশ কিছুটা ঘটলেও রাজনীতিতে এখনও সংঘর্ষের সমতা আনতে হলে মেয়েদের শরীরই হয়ে ওঠে বোঝাপড়ার ক্ষেত্র। তাই আমাদের উপমহাদেশে উপরের দিকের রাজনীতিতে মেয়েদের প্রবেশ থাকে বড়ই পরিবারকেন্দ্রিক— ইন্দিরা, সনিয়া, বেনজির, খালেদা, হাসিনা, সিরিমাভো বন্দনায়েক বা চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা, বসুন্ধরা রাজেরাই সেখানে ছড়ি ঘোরান। তবু তার মধ্যে উঠে আসেন দুয়েক জন মমতা, জয়ললিতা বা মায়াবতীরা। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন চললে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা বলা মুশকিল। না হলে ‘মেয়ে হয়েও’ নয়, ‘মেয়ে বলেই’ তাঁরা সুশাসনের উৎস হবেন আশা করা যায়।

বিজ্ঞানী টিম হান্ট বেফাঁস কথা বলেই ক্ষমা চেয়েছেন, এমনকী বিভিন্ন পদ থেকে ইস্তফাও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও ভুল স্বীকার করাটাই উচিত ছিল। করলে তিনি সাধারণ স্ত্রী-বিদ্বেষী ভারতীয় পুরুষদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারতেন। সেটা তাঁর পক্ষে ভালই হত বোধহয়।

abp post editorial unwanted shameful narendra modi on woman tim hunt nobel lauriate tim hunt shaswati ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy