Advertisement
E-Paper

মৃতদেহের মূল্য

রামায়ণে মৃতদেহের ভূমিকা প্রকটতর। ক্রৌঞ্চের মৃতদেহ ভূতলে না পড়িয়া থাকিলে পৃথিবীতে শ্লোকের জন্মই হইত না। রামায়ণেরও নহে। যুদ্ধকাণ্ডে, রাবণ এক দিন মতলব করিয়া বিদ্যুজ্জিহ্ব নামে এক রাক্ষসকে দিয়া রামের মায়ামুণ্ড প্রস্তুত করাইয়া, তাহা সীতার নিকট লইয়া যাইয়া বলিলেন, তোমার স্বামী যুদ্ধে হত, এই তাঁহার কর্তিত মুণ্ড।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ০০:৪৪
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অসাধারণ মানুষের মৃত্যুর পর তাঁহাদের মূর্তি গড়া হয়, কীর্তি ও বাণী লইয়া যুগ যুগ ধরিয়া বিশ্লেষণ চলে। সাধারণ লোকের মৃত্যুর পর সমাজের নিকট তাহার মূল্য থাকে না। কিন্তু সত্যই কি জীবনের অবসানের সহিত মানুষের অবদান ফুরাইয়া যায়? গভীর তত্ত্বটি লইয়া তীব্র চিন্তার পর, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলি সিদ্ধান্তে উপনীত: মানুষ বরং মৃত্যুর পর অধিক মূল্যবান হইয়া উঠে। রাজনৈতিক যুদ্ধে জীবিতের তুলনায় মৃতের ভূমিকা কোনও অংশে কম নহে, জীবনে কেহ রাজনীতিকে কলসির কানা মারিলেই যে মৃত্যুর পর রাজনীতি তাহাকে প্রেম বিলাইবে না, তাহার অর্থ নাই। বিশেষত যদি সে কোনও সংঘাতে মারা যায়, এবং তৎক্ষণাৎ তাহাকে প্রতিপক্ষের হীন কর্মসূচির শিকার বলিয়া প্রচার করিয়া, কদর্য হাঙ্গামা বাধাইয়া, নিজ দলের ক্রোড়ে সমর্থনের গাঢ় ঝোল টানা যায়। মৃতকে জীবনক্রীড়ার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিষেকের অভ্যাস বঙ্গীয় রাজনীতিকে স্বতন্ত্র করিয়াছে।

এবং এই বীক্ষা ভারতীয় ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত। এক বৎসর অজ্ঞাতবাসের পূর্বে অস্ত্রশস্ত্রগুলি পাণ্ডবেরা রজ্জুবদ্ধ করিয়া লুকাইয়া রাখিলেন শমীবৃক্ষের শাখায়। তাহার পর এক মৃতদেহ বাঁধিয়া দিলেন বৃক্ষে, যাহাতে ভয়ে ও ঘৃণায় কেহ নিকটে না আসে। যে গোপালক ও মেষপালকরা হাঁ করিয়া তাঁহাদের কাণ্ড দেখিতেছিল, তাহাদের নকুল বলিলেন, ইনি তাঁহাদের মাতা, বয়স প্রায় একশত, মৃতদেহ বৃক্ষে বাঁধিয়া রাখাই তাঁহাদের কুলধর্ম। এই ব্যবহারে ও অনৃতভাষণে মৃতদেহের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন হইল বলিয়া কেহ ভুল করিতে পারেন, কিন্তু অজ্ঞাতপরিচয় নগণ্য বৃদ্ধা মৃত্যুর পর ভীমার্জুনের দিব্যাস্ত্ররাশির পাহারাদারিতে নিযুক্ত হইলেন, ইহা কি তাঁহাকে চরম উচ্চাসন দান নহে? তিনি তো মহাকাব্যে দুরন্ত ভূমিকা পালন করিলেন, কারণ অস্ত্ররাশি খোয়া যাইলে, পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গো-হার হারিতেন! কেবল এই ক্ষেত্রেই নহে, মৃতদেহের নিকট পাণ্ডবদের বহু ঋণ। যখন দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলিয়া পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠাইলেন, জতুগৃহে তাঁহাদের বাসের বন্দোবস্ত করিলেন ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করিলেন, বিদুরের কথা শুনিয়া পাণ্ডবেরা গর্ত খুঁড়িয়া গৃহ হইতে পলায়নের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গৃহ দগ্ধ হইল, অথচ পাণ্ডবদের দেহ মিলিল না, ইহা হইলে দুর্যোধন সকলই বুঝিয়া নূতন চক্রান্ত ভাঁঁজিবেন। তাই পাণ্ডবেরা অনেককে নিমন্ত্রণ করিয়া প্রচুর খাদ্য ও আসব দিলেন, এক নিষাদী ও তাঁহার পাঁচ পুত্র প্রবল মদ্যপান করিয়া নেশানিদ্রামগ্ন হইলেন। তখন পাণ্ডবেরা গৃহে অগ্নিসংযোগ করিয়া পলাইলেন। প্রাতে ছয় দগ্ধ দেহ দেখিয়া লোকে ভাবিল, কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব। আবারও এক অজ্ঞাতবাসে সাহায্য করিল কয়েকটি মৃতদেহ। কে না জানে, অজ্ঞাতবাসের বিশ্রাম ও প্রস্তুতিই তুঙ্গমুহূর্তের তুখড় দক্ষতার ধাত্রী!

রামায়ণে মৃতদেহের ভূমিকা প্রকটতর। ক্রৌঞ্চের মৃতদেহ ভূতলে না পড়িয়া থাকিলে পৃথিবীতে শ্লোকের জন্মই হইত না। রামায়ণেরও নহে। যুদ্ধকাণ্ডে, রাবণ এক দিন মতলব করিয়া বিদ্যুজ্জিহ্ব নামে এক রাক্ষসকে দিয়া রামের মায়ামুণ্ড প্রস্তুত করাইয়া, তাহা সীতার নিকট লইয়া যাইয়া বলিলেন, তোমার স্বামী যুদ্ধে হত, এই তাঁহার কর্তিত মুণ্ড। তাহার পর একটি কার্যে স্থানত্যাগ করিলেন। সীতা আর্ত স্বরে বিলাপ করিয়া পাগলিনিপ্রায় যখন, সরমা আসিয়া মায়ার কথা বলিয়া তাঁহাকে আশ্বস্ত করিলেন। যদি সেই কর্তিত মুণ্ড দেখিয়া সীতা প্রাণত্যাগ করিতেন, রামায়ণ ও রামের মহিমার ওইখানেই অন্ত হইত। আবার ইন্দ্রজিৎ মায়াসীতা নির্মাণ করিয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে বানরসেনার সম্মুখে তাহাকে কাটিয়া ফেলিলেন। সেই মায়া-মৃতদেহ দেখিয়া বানররা উঠিয়া-পড়িয়া রামকে সে কথা জানাইতে, তিনি শোকে বিবশ হইলেন। তখন বিভীষণ আসিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া নিরস্ত করেন: ইন্দ্রজিৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নির্বিঘ্নে হোম সারিবার নিমিত্ত মায়া দ্বারা এই দৃশ্য রচিয়া, বিরোধী বাহিনীটিকে মুহ্যমান করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। অতএব যুগ যুগ ধরিয়া যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষমতাদখল, রাজনৈতিক অঙ্ক, বিরোধীকে ধাপ্পা দিবার ক্ষেত্রে মৃতদেহের ভূমিকা প্রবল, এবং ভারতীয় মহাকাব্যে সেই শিক্ষা বিলক্ষণ দেওয়া হইয়াৈছে। তাই যাঁহারা আধুনিক রাজনীতিকদের অশিক্ষিত বা ঐতিহ্যহারা বা অভূতপূর্ব দুর্নীতিপরায়ণ বলিয়া প্রচার করেন, তাঁহারা নিশ্চয় এই সাম্প্রতিক মৃতদেহবাজি দেখিয়া সকল দুর্বাক্য সংবরণ করিবেন এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতার উজ্জ্বল মৃতদেহ অচিরেই দেখিবার আশায় উৎসুক হইয়া পড়িবেন!

যৎকিঞ্চিত

বড়লোকেরা সুইমিং ক্লাবে ভর্তি হয়। কিন্তু গরিবদের কি সাঁতারের আনন্দ ও ব্যায়ামের প্রতি লোভ নেই? তাই কলকাতায় বর্ষাকালে এমন জম্পেশ জল জমতে দেওয়া হয়, যাতে পথেঘাটেই সাঁতার শিখে মানুষ লম্বা হয়, অলিম্পিকে যায়। কেউ নৌকো বানানো ও চালানো রপ্ত করে, চাকরিহীনতার বাজারে একটা সম্ভাব্য পেশার দিকে এগিয়ে যায়। কেউ সাহায্য করার জন্য অচেনা মানুষের হাত ধরে ফেলে, পরবর্তী জীবনে আর ছাড়ে না। ভাবতে বসলে আনন্দাশ্রুর তোড়ে জমা জল বেড়ে যায়!

War Dead Bodies
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy