ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো এক বার লিখেছিলেন আমাদের প্রত্যেকের মাথায় একটি ফ্যাসিস্ট লোক বাস করে। সেই লোকটি আদ্যন্ত হিংস্র, ক্ষমতালোভী, এবং ক্রূর। তার মানে কিন্তু এই নয় যে লোকটি রোজ দাঙ্গা বাধায় বা রোজ বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় গণধোলাইয়ের ইস্তাহার বিলি করে। তার মানে এ-ও নয় যে আমরা সবাই সারা দিন কুটিল সন্ত্রাসের ছক কষি আর অবসর সময়ে বোমা বাঁধি। বস্তুত, সেই ফ্যাসিবাদী লোকটাকে সহজে দেখা যায় না। লোকটা লুকিয়ে থাকে আমাদের দৈনন্দিন আচার আচরণে, আমাদের কাজে ও কথায়। রোজকার আচরণের ছোট ছোট হিংসা, কথার বাঁকে লুকিয়ে থাকা ঘৃণা বা কুৎসিত নানা নিপীড়নের ঘটনায় লোকটাকে চেনা যায়, বোঝা যায়, হ্যাঁ, সে আছে, বহাল তবিয়তেই আছে। এমনকি আমরা যাঁরা নিজেদের আধুনিক এবং প্রগতিশীল বলি, নিজেদের রাজনৈতিক জীব ভাবতে ভালবাসি, তাঁদের রোজকার আচরণেও প্রায়শই এই লোকটির উপস্থিতি বড্ড প্রকট হয়ে ওঠে। এটি কোনও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় নয়, তাই একে আমরা বলব ছোট ফ্যাসিবাদ।
ছোট ফ্যাসিবাদের বাস আমাদের মাথায় ও মনে, কিন্তু তার মূল লক্ষ্য ক্ষমতার এমন একটি চেহারা, যা আদ্যন্ত সর্বজনীন, যে ক্ষমতার কাঠামোটি আমাদের সবার মধ্যে থেকেও দিব্যি অদৃশ্য ভাবে বিরাজ করে। এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে ছোট ফ্যাসিবাদের এই ক্ষমতাপ্রেম একেবারে অহৈতুকী। ক্ষমতার আরও পাঁচটি উৎসের মতোই ক্ষমতাপ্রেমও আরও বেশি বেশি লোককে নিজের এক ও একমাত্র ভরকেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। যত লোক তত আমোদ। যত বেশি জনবল তত উৎকট ক্ষমতার প্রদর্শন। আদতে অন্তহীন একটি খেলা।
এর পাশাপাশি রয়েছে আরও একটি ফ্যাসিবাদ, যা বড় এবং ঐতিহাসিক, যা হিটলার বা মুসোলিনিতে গিয়ে শেষ হয়। এই ক্ষমতার ধরনটিকে চেনা সহজ, কারণ এটির সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ রয়েছে, আর নানা ভাষ্যে এবং বিবরণীতে এর গলিঘুঁজিও আমাদের জানা। বিংশ শতাব্দীর অনেক হিংসা, অনেক মারামারি আর অনেকগুলো যুদ্ধের মূলে এই বড় ফ্যাসিবাদ। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে এই বড় ফ্যাসিবাদের একটা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চেহারা ছিল বটে, তবে তার সঙ্গে সাধারণ একটা মান্যতাও ছিল। অনেকেই এই উগ্র রাজনীতিকে সমর্থন করেছিলেন, বেশ নির্দ্বিধায়।
আসল গোলমালটা বাধে যখন বড় আর ছোট ফ্যাসিবাদের দেখা হয়, যে মুহূর্তে তারা একে অপরকে দোসর বলে চিনতে পারে। ছোট ছোট দৈনন্দিন হিংস্রতাগুলো তখন একটা বেশ মান্যতা পেয়ে যায়। মনে হয় সবাই যখন বলছেন তখন যুদ্ধটা নিশ্চয়ই তত খারাপ কিছুও নয়। এই যে নানা মন্ত্রী-সান্ত্রিরা চেঁচিয়ে বলছেন দেশমাতা রক্ত চান বা বেইমানদের নিকেশ না করলে দেশমাতার সম্মান বিপন্ন, তা কি আর একেবারে মিথ্যে হবে? মাঠেঘাটে, অলিতে গলিতে, সংবাদমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই যখন বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ রব তুলেছেন, তার নিশ্চই একটা কোনও যৌক্তিকতা আছে। এত মানুষ— তাঁদের মধ্যে অনেকেই মান্যিগন্যি— সবাই কি আর ভুল বলছেন?
আর বিপদটাও ঠিক এখানেই। হরিপদ কেরানির মাথার ভেতরের হিংস্র লোকটাও এই মুহূর্তটায় বিশ্বাস করতে থাকে। বিশ্বাস করে তার কদর্যতাটা আসলে একটা পবিত্র রাগ, দেশের ‘ভাল’র জন্য প্রয়োজনীয়। গত দু’সপ্তাহের ঘটনাবলি আমাদের এই রকম একটা বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা অনেকেই অবাক হয়ে দেখেছি আমাদের পরিচিত বা আধা-পরিচিত লোকেরা কী রকম রাতারাতি যুদ্ধের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি সন্ত্রাসের বলি হলেন ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিভিশনের পর্দায় আর সমাজমাধ্যমে এক দল লোক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সান্ধ্য আড্ডা থেকে নিদান দেওয়া হল যুদ্ধ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই, এ বারে হয় এসপার নয় ওসপার। কেউ কেউ বললেন ইতিহাসের অমোঘ দিকনির্দেশ একটি নির্ণায়ক যুদ্ধেরই দিকে। মিছিল হল, শোকসভা হল নিহত জওয়ানদের জন্য, কিন্তু কী আশ্চর্য, সব জায়গা থেকেই নাকি একটাই আওয়াজ উঠতে লাগল যে ভারতমাতা রক্ত চান, আর এক্ষুনি যুদ্ধ শুরু হোক। এ কথা সত্যি যে এই উন্মাদনার অনেকটাই পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা। কিন্তু শুধু সেটুকু বললে ভাবের ঘরে চুরি হবে। আমরা দেখেছি কী ভাবে আমাদের অনেক দিনের চেনা মুখগুলো মুহূর্তে অচেনা হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে আপাত-শান্ত গেরস্থ যুদ্ধের জিগিরে সোৎসাহে গলা মিলিয়েছে।
ছোট আর বড় ফ্যাসিবাদের এই মিলনক্ষেত্রটি কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই তৈরি হয়েছে, আমরা হয়তো ঠিকমতো খেয়াল করিনি। গো-সেবার নামে সংখ্যালঘু মুসলিমদের হত্যা, ছুতোনাতায় বিরুদ্ধমতের সবাইকে দেশদ্রোহী হিসেবে দাগানো এবং হয়রান করা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্বিচার আক্রমণ, ধর্মীয় দোহাই দিয়ে নারী ও দলিতদের ওপরে অত্যাচার চালানো, বিবিধ রূপে এবং চেহারায় রাজনৈতিক হিংসা আর গণপিটুনি, এ সবই আমাদের ছোট ফ্যাসিবাদকে বুঝিয়েছে যে কদর্য হিংসা আসলে ততটা কদর্য নয়। অনেকে মিলে করলে আর রাজনৈতিক সমর্থন থাকলে যে কোনও হিংসাই ন্যায্য হিংসা, তাতে দু’চারটে লোক মরলেও পুলিশ প্রশাসন অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে থাকবে। প্রতি রাতে টেলিভিশনের পর্দায় নানা দলের সমর্থকরা বিরুদ্ধ পক্ষের লোককে চিনিয়েছেন, তাঁদের নিকেশ করার নিদান দিয়েছেন, আর আমরা সবাই সেই হিংসা ডালভাতের সঙ্গে মেখে খেয়ে উঠে ঢেকুর তুলতে তুলতে বলেছি, “সত্যিই তো, এই বেইমানদের না তাড়ালে আর দেশটা বাঁচানো যাবে না।” অনেকেই খেয়াল করিনি যে এই দৈনন্দিন হিংসার আবহাওয়ায় আমাদের মাথার ভেতরের লোকটা আমোদ পেয়েছে, সে ভাবতে শিখেছে যে তার মতো আরও অনেকে একই রকম ভাবনা চিন্তা করে, তারাও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নামতে রাজি আছে।
একটা টিআরপি জাতীয়তাবাদ আমাদের সামনে কিছু দিন যে যুদ্ধের আবহ তৈরি করল, তা থেকে কতকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে। সীমান্ত সমস্যা নতুন নয়, আর তার আশু সমাধানের কোনও লক্ষণ এখনও আমাদের চোখে পড়ছে না। তা হলে কি এই যুদ্ধের প্ররোচনার মধ্যেই আমাদের আগামী দিনগুলো কাটবে? আমরা কি আবার পাড়ায় আসা পরিচিত কাশ্মীরি শালওয়ালাকে দেশপ্রেম শেখাতে নেমে পড়ব? নিহত জওয়ানের স্ত্রী যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বললে আমরা কি ফের তাঁকে নিয়ে কুৎসা রটাব? আমরা কি আবার সবাই দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে দেখব কে ফেসবুকে কী লিখেছেন, আর তার পর আমাদের খাপ পঞ্চায়েতে তাঁদের বিচারসভা বসাব?
প্রশ্নগুলো সহজ নয়, আর এর উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে। মনে রাখা দরকার, সীমান্তে যুদ্ধ না চাইলে আর বাস্তবের কাশ্মীরে শান্তি চাইলে, এই প্রশ্নগুলোকে নিয়েও ভাবতে হবে, নইলে বার বার এই একই চক্রের সামনে এসে পড়ব আমরা। ছোট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল এক নতুন নৈতিকতা, যা একই সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক। ব্যক্তিগত, কারণ এই নৈতিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের রোজকার অভ্যাসের মধ্যে, দৈনন্দিন যা ভাবি বা করি তার মধ্যে দিয়েই। এখানে কোনও হাতে-গরম চিত্রনাট্য নেই, কোনও সহজ সরল নীতিমালাও নেই। যা আছে তা একটা রাজনৈতিক বোধ। ছোট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা একটা বৃহত্তর লড়াইয়ের অংশ। নিজেদের মাথার ছোট ছোট লোক মিলেই সঙ্ঘবদ্ধ হিংস্র জনতা তৈরি হয়, আর বড় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা তাই নিজের মাথাতেই শুরু করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী— ছোট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই বড় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও জয়ী হয়েছে।
দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ়-এর অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy