Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

একে অন্যকে চিনলে তবেই না

সারা পৃথিবী জুড়ে এত দিন বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে এসেছে অশ্বেতাঙ্গরা— আমাদের মতো বাদামিরা এবং কালো-চামড়ার মানুষরা, পশ্চিম দুনিয়ায় যাদের গালভরা নাম অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়ান।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সারা পৃথিবী জুড়ে এত দিন বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে এসেছে অশ্বেতাঙ্গরা— আমাদের মতো বাদামিরা এবং কালো-চামড়ার মানুষরা, পশ্চিম দুনিয়ায় যাদের গালভরা নাম অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়ান। আমেরিকায় বা কানাডায় অথবা ইংল্যান্ডে কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় কোনও সাদা-চামড়ার মানুষের হাতে শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের জন্য কেউ নিগৃহীত হয়েছেন এমন খবর প্রায় প্রতিদিন কাগজে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। উলটপুরাণ ঘটল সম্প্রতি নয়ডার ঘটনায়। দুনিয়ার চোখে আমরা, ভারতীয়রাই বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষী হিসেবে প্রতিপন্ন হলাম; দেখা গেল, বাদামি চামড়ার এক জাতি কেবল গায়ের রং কালো বলেই আর একটা গোটা জাতিকে অকথ্য গাল দিচ্ছে, প্রমাণ ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মারছে, রাজধানীর বুকেই তাদের একঘরে করে রাখছে। আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষদের চেয়ে আমরা বাদামি ভারতীয়রা জাতি হিসেবে যে কতটা উন্নত তা আমরা প্রমাণ করেই ছেড়েছি!

বাকি দুনিয়ার কাছে এত দিনে কথাটা হয়তো প্রকাশ পেল, কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা যে মোটেই দরাজ নই, সেটা আমরা নিজেরা তো ভাল করেই জানি; নিজেদের দলের থেকে ভিন্ন যে কোনও মানুষকেই প্রতিবেশী হিসেবে মেনে নিতেই আমাদের বেশ কষ্ট হয়। ফরসা রঙের জন্য আমাদের লালসা ও মাজা রঙের প্রতি দ্বেষের কথা তো বহুচর্চিত; বর্ণবিদ্বেষের এ হেন আলোচনা বাদ দিলেও, পীড়াদায়ক সত্য হিসেবে থেকে যায় আমাদের এই জাতিবিদ্বেষ। ভারতের মধ্যেই অন্য প্রদেশের, অন্য ধরনের, অন্য সংস্কৃতির মানুষের জন্য আমাদের প্রীতির বড়ই অভাব।

এই বিদ্বেষের পিছনের মূল কারণ অন্য জাতি সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা। বাঙালিদের কাছে বাকি উত্তর ভারতীয়রা হল হিন্দুস্থানি আর সব দক্ষিণীরাই ম্যাড্রাসি। তাদের মুখের ভাষাও যথাক্রমে হিন্দি ও ম্যাড্রাসি; তাদের খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার, পার্বণের কথা তো বাদই দিলাম। অন্য প্রদেশের লোকেরাও বাঙালিদের সামাজিকতা বিষয়ে অজ্ঞ। সমস্যাটা মোটেই আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ নয়। বস্তুত, পশ্চিম দুনিয়াতেই এই অজ্ঞতা বেশি। সাধারণ আমেরিকানের কাছে মানচিত্রে ইরাক থেকে ইন্দোনেশিয়া পুরোটাই যেন এক দেশ। কিন্তু পাশ্চাত্যের দোহাই দিয়ে আমরা কেন নিজেদের কুয়োতেই বসে থাকব? ভারতের অন্য প্রদেশের, এমনকী কলকাতাবাসী হিসেবে বাংলার অন্য জেলার মানুষদের আমরা কেন চিনব না?

সমাধানের কথা শুরুর আগে এটা মেনে নেওয়া যাক, এই চেনাজানা হতে হবে পারিবারিক স্তরে, ছোটদের শামিল করেই। ‘টু স্টেটস’ চলচ্চিত্রের (ছবিতে একটি দৃশ্য) নায়কনায়িকার মতো বড় শহরের কোনও জাতীয় কলেজের যুবকযুবতীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে আমরা যে প্রদেশ থেকেই আসি না কেন, সবাই একই রকম পোশাক (জিন্‌স) পরি, একই ভাষা (ইংরাজি) বলি, এক খাবার (বার্গার) খাই আর এক সংস্কৃতি মানি (আইপিএল দেখি)। পারিবারিক ভিত্তিতে কিন্তু খুব সহজেই আমরা বিভিন্ন প্রদেশের মানুষদের সঙ্গে মিশতে পারি। দিল্লি, বেঙ্গালুরুর মতো যে কোনও বড় শহরেই ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের অনেক পরিবার থাকেন। কলকাতা শহরের বুকেই পঞ্জাবি, গুজরাতি, তামিল ইত্যাদি অনেক পরিবার কয়েক দশক ধরে বাস করেন; তাঁদের ছেলেমেয়েরা হয়তো বাংলা শিখে আমাদের সঙ্গে মিশে গেছে। স্কুলে তারা আমাদের বন্ধু হলেও, তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক মেলামেশা প্রায় ঘটেই না।

অথচ সহজ কিছু পদক্ষেপ অনায়াসে করা যেতে পারে। স্কুলই হতে পারে এর আদর্শ অনুঘটক। স্কুলের কাজ একসঙ্গে করার সুবাদে আমরা একে অন্যকে চিনতে পারি। আরও এক ধাপ এগিয়ে, স্কুল থেকে চালু হতে পারে এক্সচেঞ্জ বা ভাব-বিনিময় প্রকল্প, যা পশ্চিমের প্রায় সব দেশের স্কুলজীবনেই আবশ্যিক। বিলেতের ছেলেমেয়েরা পাঠক্রমের অঙ্গ হিসেবে স্কুল থেকে একত্রে ইউরোপের নানা দেশে বেড়াতে যায়; শুধু তা-ই নয়, আমার ছেলে হয়তো একা স্পেনের কোনও শহরের কোনও বাড়িতে এক সপ্তাহ কাটাল, বদলে স্পেনের সেই পরিবারের মেয়ে আমাদের বাড়ি এক সপ্তাহ থাকল, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। পারিবারিক আদানপ্রদানের জন্য তো আমরাও অনায়াসে একে অন্যের বাড়িতে থাকতে পারি। বাংলার ছেলে গুজরাতে কিছু দিন কাটাল আর তার বদলে গুজরাতের মেয়ে বাংলায় তো আসতেই পারে।

অন্য জাতিকে চেনার মূল শর্ত হল তার ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিক আচরণ জানা। ফুড-কোর্টের কল্যাণে আমরা অন্য জায়গার খাবার খেলেও ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের একেবারেই অজানা। স্কুলে তৃতীয় ভাষা হিসেবে আমরা হিন্দি বা সংস্কৃত পড়ি; আজকাল আবার ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ফরাসি বা জার্মান শেখানো হয়, কিন্তু ছেলেমেয়েদের তেলুগু বা অসমিয়া শেখানোর কথা কেউ কল্পনাও করেন না। স্কুলের পাঠক্রমে অন্য ভারতীয় ভাষা শিক্ষা চালু করা যেতে পারে সহজেই। গুজরাত থেকে মণিপুর, ছেলেমেয়েদের পারিবারিক আদানপ্রদান ভাষাশিক্ষার অজুহাতেই হোক না! জাতিবিদ্বেষ আপসেই ঘুচবে।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anti-regional culture racism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE