Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বুঝো সাধু, যে জানো সন্ধান

মন্ত্রীরা জানেন না, কোনটা সত্যি আর কোনটা ভুল?

বাংলার একটি বিশিষ্ট কাগজ একটা কার্টুন ছেপেছিল— ট্রেনের কামরার ভিতর থেকে দাঙ্গায় নিহতদের শরীরগুলো বেরিয়ে আছে। সেই কার্টুন দেখে আমাদের জলপাইগুড়ি শহরে হঠাৎ দাঙ্গা বেধে গেল। শহরে তেমন কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তিই ছিল না। 

ভারতের প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে অভিনন্দন। ফাইল চিত্র।

ভারতের প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে অভিনন্দন। ফাইল চিত্র।

দেবেশ রায়
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৬
Share: Save:

যুদ্ধবিগ্রহ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় সরকারের একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকে যত দূর পারা যায় দেশের মানুষজনকে সত্য তথ্য জানানো। বা, সরকারের বলা কথাকেই সত্য প্রমাণের। বাস্তবে সেটা সব সময় নানা কারণে সম্ভব হয় না। দেশের স্বার্থে যুদ্ধের সময় ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো গৃহযুদ্ধের সময় সব সত্য সংবাদ দেশের সরকারের পক্ষে অসুবিধে তৈরি করতে পারে। তখন সত্য গোপন করতেই হয়। কিন্তু সাধারণত সরকার বা সেনাবাহিনীর কোনও প্রতিনিধি প্রত্যক্ষত এমন সত্য গোপনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মাদ্রাজের একটি লোককে এই গুজব রটানোর জন্য যুদ্ধকালীন আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল যে লর্ড ওয়াভেল-এর পা ভেঙে গিয়েছে বলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না (তথ্যসূত্র: ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার’)। কিন্তু সরকারের কাউকে তো এই আইনে গ্রেফতার করা যায় না। অথচ সরকারের তো গুজব তৈরির দরকারও হয়।

আমরা তো যুদ্ধ ও দাঙ্গার ভিতর দিয়েই এই বয়সে পৌঁছেছি। দাঙ্গার সময় ১৯৪৬-১৯৫০ সালে কলকাতার বাংলা কাগজগুলি দাঙ্গার মিথ্যে ও অপ্রমাণিত খবর ছাপানোর ফলে জেলা-মফস্সলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ত। বাংলার একটি বিশিষ্ট কাগজ একটা কার্টুন ছেপেছিল— ট্রেনের কামরার ভিতর থেকে দাঙ্গায় নিহতদের শরীরগুলো বেরিয়ে আছে। সেই কার্টুন দেখে আমাদের জলপাইগুড়ি শহরে হঠাৎ দাঙ্গা বেধে গেল। শহরে তেমন কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তিই ছিল না।

২০০২ সালের গুজরাতের গোধরা দাঙ্গার সময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ দশটির বেশি মন্ত্রকের দায়িত্বে। সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়েছে— এই কথা প্রচারিত হওয়ার পর দাঙ্গা একটু থমকে গিয়েছিল। কিন্তু তার পর মুখে মুখে রটনা হয়ে গেল যে সেনাবাহিনীকে শহরে আনা হয়নি— বাহিনী এয়ারপোর্টেই আছে। এ দিকে সেনাবাহিনী আসছে বলে রাস্তা থেকে পুলিশও তুলে নেওয়া হয়েছে। এটা কাকতালীয় না গুজবতালীয় বলা মুশকিল। কিন্তু গুজরাত দাঙ্গার এই ঘটনাক্রম আদালতে নথিভুক্ত। সেই মামলা এখনও চলছে। গোধরা দাঙ্গার দ্বিতীয় দফা আর যেন থামছিল না এই সব গুজবের ফলে।

যুদ্ধকালীন নয়, অথচ আসলে যুদ্ধই চলছে— এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সবচেয়ে প্রধানরা মিথ্যে খবর রাজনৈতিক খবর হিসেবে রটান ইটালিতে ও জার্মানিতে ১৯২০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মুসোলিনি ও হিটলার। দেশের পর দেশ তাঁরা যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে দখল করে নিচ্ছেন আর বাইরে সংবাদ হচ্ছে— সেটা দুই দেশের ভিতরে চুক্তির ফলেই ঘটছে, দুই দেশের সম্মতিতে। আর, তেমন হওয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মতি (কনভেনশন) আছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতীয় বায়ুসেনা অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দিয়ে ওয়াঘা সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। দুই দেশের ভিতর অপ্রীতির পরিবেশে এই ব্যবহার নিঃসন্দেহে ভাল খবর।

ভারত সরকারের দু’জন মন্ত্রী ঠিক এর উল্টো কথা বললেন। আইনমন্ত্রী বললেন, জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী সাত দিনের মধ্যে অভিনন্দনকে ফেরত দিতেই হত, পাঁচ দিন আগে দিয়েছে— এই তো! এ আর এমন কী! আর আমাদের অর্থমন্ত্রী বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে বিন লাদেনকে ধরতে পারে ও মারতে পারে, তা হলে আমরা পারব না কেন?

দুটো কথাই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভুল। কিন্তু এমনই সচেতন ভুল যে ভুলের মোড়কটাকেই সত্য বলে মনে হয়। যেন, সবচেয়ে লাগসই যুক্তি ও সবচেয়ে স্বাভাবিক।

এতে তো একটু লজ্জা লাগে। ভারত সরকারের এমন প্রধান দুই মন্ত্রী এটুকু জানেন না— কোনটা সত্য আর কোনটা ভুল। এঁদের হাতে আমাদের জীবনমৃত্যু? অথবা সব জেনে ভুল বলছেন? দুটোই তো লজ্জারই কারণ। জেনিভা কনভেনশনের সম্মতিগুলি তৈরি হয়েছে ১৮৬৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিরাশি বছর ধরে। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধের অস্ত্র-ব্যবহারের ধরন একেবারে বদলে গিয়েছে। অস্ত্রও নতুন নতুন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধে প্লেন বোমা ফেলার বাহন হিসেবে ব্যবহৃতই হয়নি। বোমার ধ্বংসক্ষমতা সীমাবদ্ধ। অথচ ছোট ছোট যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। তাই ‘যুদ্ধঘোষণা’ কালক্রমে একটা পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে। যুদ্ধঘোষণার পর যুদ্ধলিপ্ত দুই দেশকে কতকগুলি শর্ত মানতে হবে।

যুদ্ধবন্দি হস্তান্তরের যে সাত দিনের সীমার কথা আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন তার প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত দেশগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে। ভারত ও পাকিস্তান কি তা করেছে? ভারত ও পাকিস্তান কি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধরত? পরিস্থিতিটা কী, তা ব্যাখ্যা করছি না। ভারত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে নেমেছে— সে সন্ত্রাসবাদের পিছনে পাকিস্তানের সমর্থন আছে বলে ভারত যুক্তিসঙ্গত ভাবেই মনে করে। সেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও করতে পারে। তেমন অধিকার ভারতের আছে। কিন্তু সেটা কোনও ভাবেই ‘যুদ্ধ’ নয়। সুতরাং জেনিভা সম্মতির ধারা প্রয়োগের প্রশ্নই আসে না। বেশ কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক এরোপ্লেন সব প্যাসেঞ্জার নিয়ে ছিনতাই হচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করল, তারা এর শিকড় উপড়ে ফেলবে। বোধ হয় আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিমান কোম্পানির বিমান ছিনতাই ছিল অব্যবহিত কারণ। যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোকে দোষী দেশ বলে ঘোষণা করে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলে গদ্দাফির সন্ত্রাসবাদী ব্যবসা বন্ধ করে দিল। সেখানে জেনিভা কনভেনশনের কথা উঠেছিল এক বারও। যত দূর মনে পড়ে রাষ্ট্রপুঞ্জেও কথাটা ওঠেনি। অভিনন্দন বর্তমানকে পাকিস্তান ছেড়েছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। আমাদের আইনমন্ত্রী যদি সে রাজনীতি বুঝে উঠতে না পারেন, তা হলে আমাদের কপালপোড়া।

দুই নম্বর কথা: অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে নিয়ে। তিনি বিন লাদেন-এর কথা তুললেন। শুনেছি তো উনি উকিল ও উকিল হিসেবে ভালই। জোড়া মিনার ধ্বংসের ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সারা পৃথিবীর সামনে ঘোষণা করেন: ‘‘আমেরিকা আক্রান্ত। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এই যুদ্ধে ঢুকে পড়েছি। অপরাধীরা যে দেশের যে গুহায় ও গর্তে লুকিয়ে থাক আমরা তাদের খুঁজে ও খুঁড়ে বার করব ও আমাদের ইচ্ছেমতো শাস্তি দেব।’’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই কমান্ডার ইন চিফ। যুদ্ধ ঘোষণার একমাত্র অধিকার তাঁরই। তার পর সেই যুদ্ধ দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালিত হয়— প্রেসিডেন্ট বদলে গেলেও। ঘোষিত যুদ্ধের রীতি অনুযায়ীই সে যুদ্ধ পরিচালিত হয় ও বিভিন্ন দেশের ভিতর বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমেরিকা পাকিস্তানে প্রবেশ করে ও তাদের এক ও একমাত্র লক্ষ্যকে খুঁজে বার করে ও হত্যা করে।

ঠিক এই ভাবেই হিটলারের বাহিনী পোল্যান্ডে ঢোকার পর ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও তার অনেক পরে পার্ল হারবারে জাপান বোমা ফেললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করে।

এগুলো তো ইতিহাসের তথ্য, জেনিভা সম্মতির ভিত্তি ও বিন লাদেন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণ। এই সমস্ত প্রসঙ্গ টেনে এনে ভারত-পাক সম্পর্কের সাম্প্রতিক উত্তাপ ও অনিশ্চয়তাকে প্রসঙ্গচ্যুত করা হচ্ছে কেন? যুদ্ধ ও রাজনীতি দু’টি পৃথক সম্পৃক্ত রাজনৈতিক ক্রিয়া। তাদের গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন? বুঝো সাধু যে জানো সন্ধান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abhinandan India Pakistan Conflict War
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE