ইন্দ্রেশ কুমার। ছবি: পিটিআই
জাতীয়তাবাদের উগ্রতা কী ভাবে বাড়ছে ভারতে, তার আরও এক নিদর্শন মিলল। মুম্বইতে আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমারের ভাষণ আভাস দিল আরও কতখানি প্ররোচিত করা হবে এই উগ্রতাকে। ২০২৫ সালের মধ্যে পাকিস্তান ভারতে মিশে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্ন পূরণ হবে— এই তত্ত্বেরই অবতারণা করেছেন ইন্দ্রেশ কুমার। লাহৌর, ইসলামাবাদ, করাচি, রাওয়ালপিণ্ডি, শিয়ালকোট, সবই ভারতীয়দের হবে— এইরকম বার্তাও দিতে চেয়েছেন তিনি। এই তত্ত্বের অবতারণাকে অত্যন্ত স্থুল মাপের প্ররোচনা ছাড়া আর কী বলব?
আরএসএস নেতা যা বলেছেন, তাতে এক সর্বগ্রাসী মানসিকতার নিহিতি। আর কয়েক বছরের মধ্যে পাকিস্তান ভারতে মিশে যাবে— এই কথা বলার নেপথ্যে আসলে ক্রিয়াশীল এক ভয়ঙ্কর সংখ্যাগুরুবাদ। এই উপমহাদেশে ভারতীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং ভারতের সঙ্গে কোনও বৈরিতা রাখার অবকাশ কারও সামনে থাকবে না, বৈরী কেউ হয়ে উঠলে ভারত তাকে গ্রাস করবে— ইন্দ্রেশ কুমারের বক্তব্যে সাড় কথা এই।
পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আর এক রাষ্ট্রের বৈরিতা বা বিদ্বেষ কাম্য নয়। সুতরাং ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে প্রবাহিত হতে থাকা বিদ্বেষের স্রোত বন্ধ হওয়াই কাম্য। কিন্তু বিদ্বেষে ইতি টানার যে সূত্র সঙ্ঘ নেতা বাতলেছেন, তা কি আদৌ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারবে? নাকি এই তত্ত্ব পাকিস্তানের স্নায়ুতন্ত্রে কোনও সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে? ভারত-পাক দ্বন্দ্বে একজন ভারতীয় অবশ্যই ভারতের পক্ষেই দাঁড়াবেন। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কোনও একটা হেস্তনেস্ত যদি হয়েই যায়, তাহলে সে সংগ্রামে ভারতের জয় হোক— যে কোনও ভারতীয় নাগরিক এমনটাই চাইবেন। কিন্তু ক’জন ভারতীয় নাগরিক স্বপ্ন দেখেন যে, পাকিস্তান ভারতে পুরোপুরি মিশে যাবে? নাগরিকদের দৈনন্দিন চর্চায় পাকিস্তানকে ভারতে মিশিয়ে ফেলার তত্ত্ব আদৌ কি আলোচিত হয়? পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে গোটা ভারত জুড়ে পাকিস্তান বিদ্বেষ তীব্র হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ভারতে মিশিয়ে ফেলার দাবিতে নাগরিকদের সরব হতে শোনা যায়নি। অর্থাৎ আরএসএস নেতা আগ বাড়িয়ে এক উগ্রতর জাতীয়তাবাদ চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। এমন একটা সময়ে চেষ্টাটা করলেন, যখন সীমান্তে উত্তেজনা সামান্য হলেও থিতিয়ে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। একে প্ররোচনা ছাড়া আর কী বলব?
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
পৃথিবীর এই প্রান্তটায় আমরা বৃহৎ শক্তি, আমরা বৃহৎ অর্থনীতি, আমরা বৃহৎ জনগোষ্ঠী, আমাদের দুর্জয়ে সমরসজ্জা। অতএব আমরাই শেষ কথা বলব। আমাদের সঙ্গে বৈরিতা রাখার বা আমাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শনের ধৃষ্টতা যাঁরা দেখাবেন, তাঁরা আমাদের মধ্যে গ্রস্ত হয়ে যাবেন, পৃথক অস্তিত্ব আর থাকবে না। এইরকম একটা মানসিকতাই কাজ করছে ইন্দ্রেশ কুমারের প্ররোচনার নেপথ্যে। পাকিস্তান একটা স্বতন্ত্র এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার যাবতীয় অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে। ভারতবিরোধী সন্ত্রাসকে নিজের মাটিতে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়ার অধিকার পাকিস্তানের নেই। তার জন্য পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হোক, প্রত্যেক ভারতবাসীই তা চান। কিন্তু পাকিস্তান আর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে না, পাকিস্তানকে আমরা গ্রাস করে নেব— এইরকম কথাবার্তা বলার মধ্যে কোনও মহানুভবতা নেই, সঙ্কীর্ণতাই রয়েছে বরং।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এই ভয়ঙ্কর সংখ্যাগুরুবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আজ ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে এই উগ্র মতবাদ প্রয়োগের প্রস্তাবনা হচ্ছে। কাল ঘরোয়া বিবাদ বা অভ্যন্তরীণ সঙ্কটেও এই একই প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারে। অতএব সর্বগ্রাসী সংখ্যাগুরুত্ব কিছুতেই সমর্থনীয় নয়। মনে রাখতে হবে গুরু তখনই প্রকৃত অর্থে গুরু, যখন সে গুরুর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। গুরু শুধু অধিকার ফলিয়ে হয়ে ওঠা যায় না, কর্তব্য পালনেও সমান পারদর্শীতা থাকা জরুরি। গুরুর সে কর্তব্য কার প্রতি? নিঃসন্দেহে লঘুর প্রতি। এই কথাটা মাথায় রাখলেই উগ্রতার শিবির থেকে আসা যাবতীয় প্ররোচনা ভোঁতা হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy