Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পূর্ণ উল্টো পথে

কাশ্মীরের মানুষকে মারতে মারতে আর কত দূরে সরাব আমরা

গত কয়েক বছর ধরে বহু আলোচনা হয়েছে, কাশ্মীরিদের মন কী ভাবে ভারতের প্রতি আরও বিষিয়ে উঠছে দিন দিন। পুলওয়ামা-কাণ্ডেও আত্মঘাতী জঙ্গিটি কিন্তু পাকিস্তানে ট্রেনিং নেওয়া জঙ্গি নয়, নেহাত উপত্যকার লেঠিপোড়া গ্রামের স্কুলে পড়া কাশ্মীরি, যে কয়েক বছর আগে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে (তার আত্মীয়দের ভাষায়, অকারণেই) বেধড়ক মার খেয়েছিল ভারতীয় সেনার হাতে।

স্বদেশ! কাশ্মীরিদের উপর আক্রমণ আটকাতে কারফিউ জারি হলে পুলিশকে রুখতে পথে নেমে আসেন জম্মুবাসী, জম্মু, ১৭ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

স্বদেশ! কাশ্মীরিদের উপর আক্রমণ আটকাতে কারফিউ জারি হলে পুলিশকে রুখতে পথে নেমে আসেন জম্মুবাসী, জম্মু, ১৭ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

ভারতের নানা জায়গায় কাশ্মীরের ছাত্রছাত্রীরা, শালওয়ালারা সন্ত্রস্ত ও নির্যাতিত হচ্ছেন, শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ উপত্যকায় ফিরে গিয়েছেন, কেউ ফিরছেন। আর মন্ত্রী বলছেন, কই, কিছু শুনিনি তো? সব মিলিয়ে যা চলছে— তাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি তো যে, কাশ্মীরিরা ফিরে গিয়ে নিজেদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বলবেন, ‘এই যে দেখে এলাম, ভারতই কিন্তু আমার-তোমার দেশ, তোমরা যেন কেউ অন্য রকম ভেবো না?’ ভারতের এক প্রদেশের রাজ্যপাল থেকে সব প্রদেশের জ্ঞানগর্ভ ফেসবুকোদ্দীপ্ত দেশপ্রেমিকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের বয়কট করা হোক। আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি তো যে, কাশ্মীরিরা এতেই বুঝবেন দেশপ্রেমিকরা আসলে বলতে চাইছেন, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ?

গত কয়েক বছর ধরে বহু আলোচনা হয়েছে, কাশ্মীরিদের মন কী ভাবে ভারতের প্রতি আরও বিষিয়ে উঠছে দিন দিন। পুলওয়ামা-কাণ্ডেও আত্মঘাতী জঙ্গিটি কিন্তু পাকিস্তানে ট্রেনিং নেওয়া জঙ্গি নয়, নেহাত উপত্যকার লেঠিপোড়া গ্রামের স্কুলে পড়া কাশ্মীরি, যে কয়েক বছর আগে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে (তার আত্মীয়দের ভাষায়, অকারণেই) বেধড়ক মার খেয়েছিল ভারতীয় সেনার হাতে। আত্মীয়দের বয়ান অবিশ্বাস করা মুশকিল। এই কয়েক বছরে যত কাশ্মীরি বালকবালিকা যুবকযুবতীর ছবি আমরা দেখেছি, পথে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দিকে পাথর ছুড়ছে, আর উল্টে সেনার হাতে প্রাণ কিংবা শরীরের কোনও না কোনও অংশ খুইয়ে আসছে— তারা কেউ জন্ম থেকেই পাকিস্তানি সরকার বা জঙ্গিবাহিনীর খপ্পরে পড়েছিল, এতটা নরেন্দ্র মোদীও দাবি করবেন না। তা হলে কেন তারা আক্রমণের জন্য এতটা মরিয়া? কেননা ইতিমধ্যে কয়েক প্রজন্মের কাশ্মীরিরা দেখে এসেছে সেনার বাড়াবাড়ি, ‘সেনাবাহিনী=ভারতীয় রাষ্ট্র’ এই সমীকরণকে জান দিয়ে ঘৃণা করতে শিখেছে। হাঁটতে শিখেই দেখেছে বাড়ির গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক উঁচিয়ে সেনা। প্রতি পদে দেখাতে হয়েছে আই-কার্ড। (মনে আছে, ‘হায়দর’ সিনেমা?) চার পাশে দেখেছে সেই মানুষগুলোকে, এই উপমহাদেশে যাদের তুলনা কাশ্মীরের বাইরে খুঁজে পাওয়া ভার: ‘হাফ-উইডো’। এই মহিলারা বৈধব্য যাপন করেন, কিন্তু জানেন না সত্যিই তাঁরা বিধবা কি না। স্বামীর জীবনসংবাদের আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু মৃত্যুসংবাদটুকু পাওয়ার জন্যই তাঁরা অশ্রুভরা চোখে চেয়ে থাকেন সেনা ছাউনির দিকে।

কাশ্মীরে যে ভারতীয় জওয়ানদের প্রাণ গেল, তাঁদের পরিবার ও ছেলেমেয়েদের কথা ভাবলে চোখে জল আসে। কী-ই বা এই ছেলেগুলির বয়স, তাঁদের পুত্রকন্যারা সব শৈশবে, কৈশোরে, তাঁদের স্ত্রীরা কুড়ি-ত্রিশের স্বপ্নমাখা যৌবনে— এই ফাল্গুন তাঁদের সকলকে স্বপ্নহারা করল। একই ভাবে চোখে জল আসে যখন ভাবি এই তিন বছর আগে— ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে ভারতীয় সেনার হাতে নিহত হওয়া ১২০টি কাশ্মীরি ছেলেমেয়ের কথা। সদ্য স্কুল-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েগুলি। জীবনের রহস্য ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই তাদের মায়ামাখা মুখগুলি মাটি দিয়ে চিরতরে চাপা দিতে কেমন লেগেছিল ওদের বাবা-মায়েদের? পুলওয়ামার শোক তাই কুপওয়াড়ার শোকও টেনে আনে আবার— কেননা শোকের কোনও শ্রেণিভাগ হয় না, জাতি-রাষ্ট্র-ধর্ম কিছু দিয়েই তার বিচার চলে না। প্রতিটি জীবন মহামূল্যবান। আর সেই মূল্যবান প্রাণগুলো এই ভাবে নয়ছয় করে চলেছি আমরা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক!

দশকের পর দশক, তবু কিছু বাড়া-কমা তো আছেই। আর তা দিয়েই বিচার করতে হবে কাশ্মীর-ভারত-পাকিস্তান বিষাক্ত অক্ষটির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। ২০১৬ সাল থেকে ঘটনাপ্রবাহ মন দিয়ে দেখলে, বলতেই হবে— দুঃখিত প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি, যে নীতি আপনারা গত কয়েক বছর পালন করে এলেন, সেই দমন নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সঙ্কট তা দিয়ে এক চুল কমেনি। জীবন হারানোর পরিমাণ বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। বেড়ে গিয়েছে কাশ্মীর নিয়ে চিন্তাভাবনাহীন জ়িঙ্গোবাদীর আস্ফালন। কেউ আর কিছু না জানলেও জানে যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানটা হল কাশ্মীরিদের ঠেঙানো কিংবা বয়কট করা। এত নির্বোধের মতো কথা বুক ফুলিয়ে বলার সাহস এরা পেয়েছে বিজেপি সরকারের আশকারাতেই। এ কেবল অন্যায় নয়— সম্পূর্ণ উল্টো ফল ফলানোর ব্যবস্থা। এই যে আশ্চর্য ঔদ্ধত্য ও অসভ্যতা আমরা দেখালাম, কাশ্মীরের মন থেকে এর ছাপ অনেক দিন মুছবে না। একটা গোটা উপত্যকার সব মানুষকে সন্ত্রাসবাদী ভেবে ফেলা হল। আমাদের সাধের কলকাতাতেও কাশ্মীরি বাচ্চাদের সঙ্গে নিজেদের বাচ্চাদের এক স্কুলগাড়িতে পাঠানো হল না, পাছে কাশ্মীরি বাচ্চারা বোমা ফেলে!

আরও পড়ুন: বিরুদ্ধ স্বরকে দাবিয়ে দিতে শুরু হয়েছে ভাষা-সন্ত্রাস

পুলওয়ামার পর ঘোষণা শোনা গেল, এর পর কাশ্মীর উপত্যকায় যাকেই বন্দুক তুলতে দেখা যাবে, তার মা যেন জানেন, সে দিনই ছেলে শেষ! যেন এই হুমকি শুনে কাশ্মীরি মায়েরা ছেলেদের কোলে বেঁধে রাখবেন। কাশ্মীরি মায়েদের দরকার কী, এই ভারতেই আমরা এক দিন বাঙালি মরাঠি পঞ্জাবি মায়েদের দেখেছি— জাতীয়তাবাদ নামক একটা ভাবনায় জ্বলে উঠে সন্ত্রাসের কোলে এগিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের! হুমকি দিয়ে জাতীয়তাবাদ ঠেকানো যায় না। আর হ্যাঁ, শুনতে বলতে যতই খারাপ লাগুক, বাস্তব হল, ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে কাশ্মীরিরা ভারত বোঝে না, কাশ্মীর বোঝে। অনেক দিন হল, সিন্ধুর অনেক জল বয়ে গিয়েছে এর মধ্যে, এই বাস্তব পাল্টায়নি। পাকিস্তান বুঝিয়েছে কাশ্মীরিদের দেশ পাকিস্তান, ভারতীয়রা বুঝিয়েছে কাশ্মীরিদের দেশ ভারত, আর কাশ্মীরিরা অধিকাংশই বুঝে নিয়েছেন তাঁদের দেশ কাশ্মীর। এই বাস্তবকে আজ ইচ্ছে করলেই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দিলে বা বয়কটের মহামন্ত্র শোনালে তো বাস্তব আরও পাকাপোক্ত হয়ে যাবে।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে মার্কিন সমর্থন পেতে আজ ভারত হাঁকপাঁক করছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের ভেতরে বাইরে সেই আমেরিকা দুই বছর ধরে সমানে বলে এসেছে, কাশ্মীরে ‘সিভিলিয়ান’ বা অসামরিক নাগরিকের মৃত্যু কমাতে ভারতকে উদ্যোগ করতে হবে। ভারত সে কথা কান দেওয়ার যোগ্য মনে করেনি। (আমেরিকা অবশ্য নিজেও নিজের কথায় কান দেয় না, আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় সিভিলিয়ান মৃত্যু নিয়ে বিচলিত হয় না)। কিন্তু ‘কান না দেওয়া’র গৌরব তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যদি তাতে ফলটা ভাল ফলে। ভারতের ক্ষেত্রে, কাশ্মীরের ক্ষেত্রে, ফল ফলছে বিষময়, তাই প্রশ্ন উঠবেই: পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোগ নষ্ট করলেও কাশ্মীরের ভেতরেই যদি মানুষের রাগবিরক্তি অসহযোগ কমানো না যায়, তাতে কাজ হবে কি? গাছের ডালপালাগুলো ছেঁটেকেটে দিয়ে শিকড়গুলোকে বেড়ে চলার উপযুক্ত পরিবেশ দিলে গাছটা মরে যায় কি?

আর একটা অপ্রিয় কথা এই সূত্রে। হুরিয়ত-সহ প্রায় শ’দুয়েক কাশ্মীরি নেতার নিরাপত্তা সরিয়ে নেওয়া হল পুলওয়ামার অভিঘাতে। এই নেতাদের অনেকে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন, অনেকে চাননি। কিন্তু কিসের থেকে নিরাপত্তা পাচ্ছিলেন তাঁরা? সন্ত্রাসবাদীদের থেকে। অর্থাৎ, সহজ যুক্তি বলে, এঁরা সন্ত্রাসবাদীদের বন্ধু নন। শত্রু। প্রাণভয় পাওয়ার মতো শত্রু। (হুরিয়ত নেতা মিরওয়াইজ় উমর ফারুকের বাবা মৌলবি ফারুক ১৯৯০ সালে নিহত হয়েছিলেন হিজবুল জঙ্গিদের হাতে, আর এক বিতর্কিত নেতা সাজাদ লোন এই সে দিন হুরিয়তের প্রধান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে হাত মিলিয়েছিলেন বিজেপি-পিডিপি যৌথ সরকারে, মন্ত্রীও ছিলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির অন্য সহকর্মীদের তো কথাই নেই, জঙ্গিদের এক চুলও সমর্থন না করে এঁরা নিরাপত্তা খোয়ালেন।) এর মাধ্যমে যে বার্তাটা দেওয়া হল— তা হল, এক দিকে সন্ত্রাসবাদী, অন্য দিকে বিজেপি-মার্কা জাতীয়তাবাদী, এর মাঝে আর কোনও স্থান নেই, থাকতে পারে না। কাশ্মীরিরা যে বার্তা পেলেন— যাঁরা মাঝখানে আছেন, মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন, ভারত এক দিন না এক দিন তাঁদের পিছন থেকে ছুরি মারবেই, সুতরাং সময় থাকতে সরে আসা ভাল! গত বছর কাশ্মীরের প্রখ্যাত সাংবাদিক শুজাত বুখারি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন। যারাই তাঁকে মেরে থাকুক, নিধনের পিছনে কিন্তু এই ছকটাই ছিল। যে জন আছে মাঝখানে— মেরে ফেলো তাকে। তা হলে, জঙ্গিরা যা চায়, দিল্লিও তা-ই চায়: এই সিদ্ধান্তই তো আমরা করতে পারি?

কাশ্মীর নিয়ে ভারতের কাছে কোন কোন পথ খোলা নেই, সেটা ভাবলে বোঝা যায় কোন পথটা এখনও খোলা। জিহাদিদের সন্ত্রাসপথ থেকে ফিরিয়ে আনা? সম্ভব নয়, কোনও দেশ পারেনি, আমরাও পারব না। পাকিস্তানের সামরিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক নেতাদের মন পাল্টাতে বাধ্য করা? এত দিন যখন হয়নি, আর হবে না। বরং পুলওয়ামার মতো ঘটনায় ভারত যতই গর্জাবে পাকিস্তান ততই বেশি আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে। আত্মঘাতী জঙ্গিদের আটকানো? এক জন আত্মঘাতী বেঁচে থাকতেও একটিও আর্মি ব্যাটেলিয়ন সুরক্ষিত নয় (ঠিক যে হুমকিটা দিয়েছে হিজ়বুল মুজাহিদিন)। তা হলে? পথ কোথায়? পথ একটাই ছিল। কাশ্মীরে যাঁরা মাঝখানে আছেন, ধৈর্য ধরে যত্ন করে তাঁদের আশ্বস্ত করা, নিরাপত্তা ও সুস্থতার পথ দেখানো, যাতে কোনও না কোনও দিন তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বোঝান, ‘দেখো, ভারতও তো আমাদেরই দেশ’!

সম্পূর্ণ উল্টো দিকে দৌড়চ্ছি আমরা। এই আমাদের রাজনীতি, কূটনীতি। এই আমাদের সমাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kashmir Terrorism Violence Pulwama Terror Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE