রাজ্য বিধানসভায় শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত লোকায়ুক্ত বিল পাশ হইয়াছে। বিরোধী দলগুলি আপত্তি তুলিলেও তাহা ধোপে টিকে নাই। দুর্নীতি প্রতিরোধের এই বিলের পরিসর হইতে বাদ থাকিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তিতে, তাঁহার দায়বদ্ধতা রাজ্যের নাগরিকদের কাছে, কোনও রাজনীতিকের কাছে নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্তব্যের মধ্য দিয়া কতকগুলি মৌলিক প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছেন। বিল পাশ হইল বলিয়া সেই প্রশ্নগুলি হাওয়ায় মিলাইয়া যায় না। প্রথম প্রশ্নই হইল, তাঁহার যুক্তি যদি সত্য হয়, তবে আদৌ লোকায়ুক্ত বিলের প্রয়োজন কী। সমস্ত মন্ত্রিসভাই নাগরিক সমাজের কাছে দায়বদ্ধ, প্রত্যেক সরকারি কর্তা ও কর্মীর সেই দায় রহিয়াছে। সেই দায় বা প্রত্যাশা তাঁহারা না মিটাইলে পরবর্তী নির্বাচনে সে বিষয়ে পদক্ষেপের অধিকার নাগরিকের আছে। ক্ষমতাসীন থাকাকালীন কোনও রকম দুর্নীতির প্রমাণ মিলিলে বর্তমান আইনেই সে বিষয়ে পদক্ষেপ করার সুযোগ আছে। বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হইবারও অবকাশ আছে। এই পরিস্থিতিতে আরও একটি পর্যবেক্ষক-পরীক্ষক পদের দরকার কী? গণতন্ত্র মানুষের কাছে দায়বদ্ধতার কথা বলে, কিন্তু সেই গণতন্ত্রেই দায়বদ্ধতার একটি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভেদ আছে। সেই দিক দিয়া দেখিলে, লোকায়ুক্ত পদটির প্রয়োজন বুঝা দায়। বস্তুত, লোকপাল বা লোকায়ুক্ত গোছের পদগুলির বিরুদ্ধে নীতিগত আপত্তি এইখানেই যে, তাহা অপ্রয়োজনীয়। যে কাজ বিচারবিভাগের, তাহা পুরোপুরি বিচারবিভাগকেই করিতে দেওয়া উচিত।
কিন্তু নাগরিকরা যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের পছন্দ করিয়া জিতাইয়া আনিয়াছেন, তাঁহাদের মত যদি লোকায়ুক্তের পক্ষে হয়, তবে তাহা মানিয়া লইতেই হইবে। এ দেশে লোকায়ুক্তের ভাবনা এই প্রথম, তাহাও নহে। ১৯৬৬ সালে মহারাষ্ট্রে ইহার প্রস্তাবনা হয়। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন এমন একটি সংস্কার সারা দেশের জন্য আনিতে চাহিয়াছিল। মনে করা হইয়াছিল, ইহার দ্বারা সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে নাগরিক অভিযোগগুলির অনেক দ্রুত মীমাংসা সম্ভব হইবে। তাহার পর প্রায় ১৯টি প্রদেশে এই পদের সূচনা হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ যদি সেই তালিকায় নাম লিখাইতে চাহে, লিখাক, কিন্তু তাহাতে যে দুর্নীতির তেমন ইতরবিশেষ হইবে না, অপরাপর প্রদেশের অভিজ্ঞতা হইতে তেমন অনুমানই করা চলে। বিচারই তো কেবল একমাত্র কথা নয়। বিচারের রায়টি কাজে পরিণত করিবার সুযোগ এই ব্যবস্থায় কতখানি, সেই প্রশ্ন থাকিয়াই যায়।
তবে তাহার পরেও প্রশ্ন আছে। লোকায়ুক্ত ব্যবস্থার যদি কিছু অর্থ থাকিয়াও থাকে, তাহা হইলে মুখ্যমন্ত্রীকে লোকায়ুক্তের বাহিরে রাখা হইবে কোন যুক্তিতে? মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক ব্যবস্থার শিরোভাগে অধিষ্ঠান করিতে পারেন, কিন্তু তিনি সেই ব্যবস্থারই অঙ্গ। সুতরাং প্রশাসনের দায়বদ্ধতা তাঁহারও দায়বদ্ধতা। এবং তাঁহাকে বাদ রাখিলে প্রশাসনের কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করাও অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হইতে পারে। সর্বোপরি, একটি নিরপেক্ষ নজরদারির আয়োজন হইতে মুখ্যমন্ত্রীকে বাহিরে রাখিলে সমাজের নিকট যে সঙ্কেত যায়, তাহা গণতন্ত্রের অনুকূল নহে। এই কথাটি কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে নয়, সকল মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কেই প্রযোজ্য। বস্তুত, প্রযোজ্য— লোকপাল পদটির ক্ষেত্রে— প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কেও। যাঁহার আসন যত উচ্চে, যাঁহার হাতে ক্ষমতা যত প্রবল, তাঁহার নৈতিকতার দায় ততই বেশি। সেই দায় কেবল পালন করিলেই চলে না, তাহা যে পালন করা হইতেছে— সমাজের চোখে, জনসাধারণের চোখে সেই বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করিতে হয়। তাহাই গণতন্ত্রের অন্যতম আবশ্যিক শর্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy