Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

কথার খেলাপ হয়ে যাচ্ছে যে!

সভাপতি নিয়ে আইএনটিইউসি-র এই গোলমালের সূত্রপাত সংগঠনের কেন্দ্রীয় স্তরে। কয়েক দশক ধরে এই সংগঠনের জাতীয় সভাপতি পদে আছেন জি সঞ্জীব রেড্ডি। এখন তাঁর বয়স নব্বই।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৬
Share: Save:

রাজনীতিকদের কথায় আর কাজে মিল কতখানি, তা নিয়ে ভারতবাসীকে প্রশ্ন করলে সম্ভবত খুব ইতিবাচক জবাব মিলবে না। তা সত্ত্বেও কথার ভরসাতেই এ দেশে রাজনীতি চলে। নির্বাচনী লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অন্তত কথা আর কাজের মধ্যে অমিলের সম্ভাবনা ফুটে উঠতে না দেওয়ার চেষ্টা করেন রাজনীতিকরা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস বোধহয় সেটুকুও পারছে না। কথা যে দিকে যাচ্ছে, কার্যকলাপ থাকছে তার বিপ্রতীপে।

বাংলায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে কংগ্রেস। মাঝে বছরখানেকের জন্য তৃণমূলের অবহেলিত শরিক হিসেবে শাসক জোটে নামমাত্র উপস্থিতি ছিল দলটার। সেটাকে কংগ্রেস নেতারাও ধর্তব্যে আনতে চান না। অতএব ৪১ বছর ধরে কংগ্রেস বাংলায় বিরোধী আসনে রয়েছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়াই যায়। এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কোনও দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে জনভিত্তির অবস্থা যে করুণ হয়ে পড়ে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু গণতন্ত্রে কারও সামনেই সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে যায় না। তাই পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসও ঘুরে দাঁড়ানোর বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতেই পারে।

‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’— এই বাক্যাংশ ইদানীং বার বার শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃত্বের মুখে। জোট নয়, সমঝোতা নয়, সর্বাগ্রে জরুরি দলকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী প্রদেশ কংগ্রেসকে এই বার্তাই দিয়েছেন বলে এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা বার বার জানাচ্ছেন। রাহুল গাঁধী যদি বাংলার কংগ্রেস নেতাদের এই বার্তা দিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি সঠিক মার্গ দর্শনই করেছেন। প্রথমে দশকের পর দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা, তার পরে দল ভেঙে যাওয়া আর শেষ কয়েকটা নির্বাচনে কারও না কারও সঙ্গে জোট অথবা আসন সমঝোতার ভিত্তিতে লড়া— সব মিলিয়ে কংগ্রেস নিজেই জানে না, এ রাজ্যে দলের খাঁটি জনভিত্তি এখন কতটা। আপাতত একক ভাবে পথ হেঁটে নিজেদের ওজনটা যাচাই করে নেওয়া তাই কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু একক ভাবে পথ হাঁটার জন্য অথবা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য দলে ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। রাহুল গাঁধী সেই ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেসের ছবিটাও দেখতে চান বলে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব জানাচ্ছেন। কংগ্রেস নেতারা কি রাহুল গাঁধীর স্বপ্ন পূরণে আদৌ সমর্থ হবেন?

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন: পাল্টা সম্মেলন রমেনদের, আইএনটিইউসি-তে এখন দুই সভাপতি

পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ ছবিটা বলছে, স্বপ্ন পূরণ অত্যন্ত দুরূহ। বাংলার কংগ্রেসে অভ্যন্তরীণ চোরা স্রোত, পাল্টা স্রোত, সঙ্ঘাত ইত্যাদি এত তীব্র এখন যে, ‘ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম’ শব্দবন্ধটাকে ভিন‌্গ্রহী বলে মনে হতে পারে। ঠিক কী রকম ভাবে চলছে এ রাজ্যের কংগ্রেস? দৃশ্যপটে পর পর সাজিয়ে নেওয়া যাক ছবিগুলোকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে অধীর চৌধুরীকে সরানোর দাবি রাহুল গাঁধীর দরবারে পৌঁছে দিতে শুরু করলেন একের পর এক নেতা, বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে অধীর চৌধুরীর বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হল, অবশেষে সরানো হল অধীরকে, নতুন সভাপতি হলেন সোমেন মিত্র, নতুন সভাপতির প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে ধাক্কা দিয়ে আটকে দেওয়া হল ওমপ্রকাশ মিশ্রের পোডিয়ামে ওঠার চেষ্টা, তার পরের দিন থেকে অধীর অনুগামীদের বিধান ভবনে ঢুকতে না দেওয়ার বা হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠা শুরু হল, প্রদেশ কংগ্রেস মুখপত্রের কার্যনির্বাহী সম্পাদকেরও আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ উঠল— এই ভাবে চলছিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়া কংগ্রেস। যে সব বৈঠকে যাঁদের আমন্ত্রিত হওয়ার কথা, তাঁরা সবাই আমন্ত্রিত হচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠতে থাকল। প্রদেশ কংগ্রেসের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করলেন প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান অধীর চৌধুরী। অধীর এবং সোমেন নিজেদের মতানৈক্য সরিয়ে রেখে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় থাকলেও মালদহ জেলায় কংগ্রেস অন্য পথে হাঁটতে শুরু করল। দক্ষিণ মালদহের সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী জোট প্রস্তাব নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি চলে গেলেন। উত্তর মালদহের সাংসদ তথা জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী মৌসম নূর প্রদেশ নেতৃত্বের তোয়াক্কা না করে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পঞ্চায়েত গঠনের কথা ঘোষণা করে দিলেন। প্রদেশ নেতৃত্ব অনুমোদন করল না মালদহ জেলা কংগ্রেসের এই অবস্থানকে। ইতিমধ্যেই প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন চলে এল, শাদাব খান বনাম রোহন মিত্রের লড়াই আসলে অধীর চৌধুরী বনাম সোমেন মিত্রের লড়াইতে পর্যবসিত হল। শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-ও আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গেল। কামারুজ্জামান কামারকে সভাপতি হিসেবে মানতে অস্বীকার করে রমেন পাণ্ডেকে সভাপকি হিসেবে ঘোষণা করল আইএনটিএউসি-র একটি গোষ্ঠী।

কংগ্রেস নেতৃত্বের কথা এবং কাজ যে মিলছে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐক্যবদ্ধ লড়াই এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টার কোনও লক্ষণই যে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসে পরিস্ফূট হচ্ছে না, তা বোঝার জন্য আজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ ভাবে চললে দলের ভবিষ্যত্ আরও ভঙ্গুর। দায় শুধু প্রদেশ নেতৃত্বের কিন্তু নয়। দায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীরও। বিজেপির বিরুদ্ধে সুর ক্রমশ চড়াচ্ছেন রাহুল, কংগ্রেসের প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু নিজের ঘরগুলোই গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। নির্বাচনী গন্তব্যে পৌঁছে না যাওয়া পর্যন্ত অন্তত মুলতুবি রাখতে হবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চোরা স্রোতগুলো। তা না পারলে সংগঠনটাই এগিয়ে যাবে মুলতুবি হওয়ার দিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE