—প্রতীকী চিত্র।
আলো, না কি অন্ধকার? ২০১৮ সালের অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (এএসইআর) দেখিলে আশা আর হতাশা পাশাপাশি গ্রাস করিতে পারে। সংখ্যা বলিবে, আলো এখনও বহু দূরে— এখনও ভারতে পঞ্চম শ্রেণির প্রতি এক শত পড়ুয়ার মধ্যে ৫৫ জনই দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যাংশও পড়িতে পারে না। এখনও পঞ্চম শ্রেণির মাত্র ২২.৭ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির অঙ্ক কষিতে পারে। কিন্তু, অন্য দিক হইতে ইহাও উন্নতি। ইহাও আশার আলো। কারণ, ২০০৮ সাল হইতে এই অনুপাতগুলি শুধু নিম্নমুখীই হইতেছিল। ফের ঘুরিয়া দাঁড়াইবার লক্ষণটিই আশা। সুসংবাদটি অবশ্যই বেশি উঠিতে পারে নাই। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মানের অধোগতি অব্যাহত। দশ বৎসরের ব্যবধানে পঞ্চম শ্রেণির স্তরে উন্নতির সম্ভাবনা দৃশ্যমান কেন, অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে তাহা হইল না কেন— সব প্রশ্নই গভীরতর বিশ্লেষণের দাবি জানায়। এই ফলাফলের বহুবিধ কারণ থাকা সম্ভব। কিন্তু, একটি কথা প্রায় নিঃসংশয়ে বলা চলে— ছাত্রছাত্রীদের পারা অথবা না-পারা বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষকদের পারা বা না-পারার উপর। প্রাথমিক স্তরের তুলনায় মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যক্রম জটিলতর, ফলে শিক্ষকদের দক্ষতার দাবিও অধিকতর। ভারত সম্ভবত এখনও সেই দাবি মিটাইয়া উঠিতে পারে নাই।
পশ্চিমবঙ্গ কি সেই দাবি মিটাইবার বিপরীতে হাঁটিতে চাহে? রাজ্য সরকার ‘ভাবিতেছে’, যে সব স্কুলে শিক্ষকের ঘোর অনটন, সেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ‘ইন্টার্ন’ হিসাবে নিয়োগ করা হইবে। সিদ্ধান্তটি ভোটমুখী কি না, সেই তর্ক থাকিবেই। কিন্তু, আরও অনেক বেশি উদ্বেগজনক হইল ইহা যে এই সিদ্ধান্তটি শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের, বিপুল ক্ষতিসাধন করিবে। প্রথমত, ‘ইন্টার্ন’ শব্দটির অর্থ শিক্ষানবিশ। বিএড পাঠ্যক্রমের অঙ্গ হিসাবেই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে শিক্ষক হিসাবে প্রশিক্ষণ লইয়া যাইতে হয়। কিন্তু, যে স্নাতক শিক্ষকতার পাঠ লইতেছেন না, এই প্রশিক্ষণে তাঁহার অধিকার থাকিবে কেন? এবং, কী ভাবে শিক্ষকতা করিতে হয়, যাঁহারা সেই পাঠ লইতে গিয়াছেন, তাঁহাদের হাতেই শিক্ষকতার ভার ছাড়িয়া দেওয়া প্রায় শিক্ষানবিশ পাইলটের হাতে বিমান ছাড়িয়া দেওয়ার মতো। শোনা গিয়াছে, যে স্কুলে শিক্ষকের ঘোর অভাব, মূলত সেখানেই ইন্টার্নদের পাঠানো হইবে। অর্থাৎ, শিশুশিক্ষা সম্পূর্ণত তাঁহাদেরই হাতে। তাহাতে কেন স্কুলশিক্ষার মান বাড়িতে পারে না, সেই কথাটি বুঝাইয়া বলিবার প্রয়োজন নাই।
স্কুল সার্ভিস কমিশন জানাইয়াছে, ইন্টার্ন নিয়োগের সিদ্ধান্তের প্রভাব তাহাদের কাজে পড়িবে না। কথাটির অর্থ বোঝা কঠিন। এক জন শিক্ষকও যদি কমিশনের পরীক্ষাব্যবস্থার বাহির হইতে স্কুলে নিযুক্ত হন, তাহা হইলেই পরীক্ষা প্রক্রিয়াটির গুরুত্ব খর্ব হয়। তাহার জন্য ইন্টার্ন নিয়োগ অবধিও অপেক্ষা করিতে হইবে না— ‘প্যারা টিচার’ প্রথাটিই শিক্ষার মানরক্ষায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের গুরুত্ব নষ্ট করিয়া দিয়াছে। ইন্টার্ন ব্যবস্থায় আরও ক্ষতি হইবে। কারণ, যে নিয়োগে কোনও যোগ্যতা যাচাইয়ের অবকাশ নাই, রাজনীতিতে তাহার গুরুত্ব অদ্বিতীয়। এক বার সেই দরজা খুলিলে রাজনীতি কি তাহাকে বন্ধ করিতে সম্মত হইবে? ইন্টার্ন নিয়োগের সিদ্ধান্তের পিছনে স্কুলে সম্ভবত শিক্ষকের অভাব দূর করিবার তাগিদ আছে। তাগিদ সম্ভবত কেবল শিক্ষাদানের নহে, ভোটপ্রাপ্তিরও। কিন্তু আনকোরা স্নাতক দিয়া প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব ঘোচানো যায় না। শিক্ষকের অভাব দূর করা জরুরি, কিন্তু ইন্টার্নের মাধ্যমে নহে। এএসইআর-এর পরিসংখ্যান বলিতেছে, শিক্ষার মানোন্নয়নের সুযোগ এখনও আছে। ‘ইন্টার্ন’-এর ঘোলা জলে সেই সুযোগ বিসর্জন দিলে বিরাট অন্যায় হইবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায়। সুতরাং, রাজ্যের ভবিষ্যতের প্রতিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy