Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সাক্ষীগোপাল

মানবাধিকার কমিশনের ন্যায় প্রতিষ্ঠানগুলি সংবিধানের নির্দেশে গঠিত হইয়াছে স্বাধীন ভাবে কাজ করিবার জন্য।

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৮ ০০:৩৯
Share: Save:

রোমের মানুষ যখন পুড়িতেছিলেন, তখন নাকি নিরোর বেহালা-বাদন শোনা গিয়াছিল। রাজ্যের মানুষ যখন মরিতেছে, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন তখন কী শুনাইল? কিছুই না। পুরুলিয়ায় দুই তরুণের দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় মিলিল। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ওই দুই মৃত্যুর রিপোর্ট তলব করিয়া পাঠাইয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, রাজ্য কমিশন সে বিষয়ে তদন্তও করে নাই, পুলিশের রিপোর্টও চাহিয়া পাঠায় নাই। এমনকি বিরোধীরাও রাজ্য কমিশনের দ্বারস্থ হয় নাই। রাজ্য কমিশন কিছু করিবে না, ইহাই যেন প্রত্যাশিত। এই ধারণা শুধু মানবাধিকার কমিশন লইয়া নহে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে অগণিত মহিলা প্রার্থী ও তাঁহাদের সহকর্মী-আত্মীয়রা এ বার নিগৃহীত হইয়াছেন। তাহার সাক্ষ্য সংবাদমাধ্যমে কম নাই। সেই সকলের তদন্তে দিল্লি হইতে জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা আসিলেন কলিকাতায়। কিন্তু কলিকাতা হইতে ঘটনাস্থলে গিয়া আক্রান্ত মহিলাদের সহিত কথা বলিবার কাজটি রাজ্য মহিলা কমিশন করিয়া উঠিতে পারে নাই। ঠিক একই রূপে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ভোটপ্রার্থী, ভোটকর্মী কিংবা ভোটদাতাদের উপর হিংসার কোনও অভিযোগের তদন্ত করে নাই। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দুষ্কৃতীদের প্রতি তাহাদের সহায়তার অভিযোগও বার বার উঠিয়াছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন তাহার প্রতিরোধ বা প্রতিকারে কোনও ব্যবস্থা করে নাই। তদন্তের ভার সম্পূর্ণ রাজ্যের উপর ন্যস্ত করিয়াছে। যদিও আইনের নির্দেশ, নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন পুলিশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত থাকিবে নির্বাচন কমিশনের উপর।

মানবাধিকার কমিশনের ন্যায় প্রতিষ্ঠানগুলি সংবিধানের নির্দেশে গঠিত হইয়াছে স্বাধীন ভাবে কাজ করিবার জন্য। সরকারের উপর, বিশেষত পুলিশ ও প্রশাসনের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিবার জন্য, নাগরিকের মর্যাদা এবং অধিকার সুরক্ষিত রাখিবার জন্য সর্বদা সক্রিয় ও তৎপর থাকিবে এই প্রতিষ্ঠানগুলি, ইহাই প্রত্যাশিত। ভারতের সমাজে ব্রহ্মণ্যতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র অতি প্রবল, অর্থনীতিতে প্রবল সামন্ততন্ত্র। এই শক্তিগুলিই পরিচালনা করে রাষ্ট্রশক্তিকে। ফলে সরকার মানুষের মর্যাদারক্ষায় অতি-উৎসাহী, পুলিশ ও প্রশাসন দরিদ্র ও প্রান্তবাসীর প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র, এমন দাবি করা কঠিন। এই কারণেই গণতান্ত্রিক ভারতে সরকার ও সমাজের কোপ হইতে সংখ্যালঘু, মহিলা, দলিত-আদিবাসীর জীবন ও মর্যাদা বাঁচাইতে বিবিধ কমিশন গঠন করিতে হইয়াছে। রাজ্যগুলি স্বভাবতই এমন নজরদারিতে খুশি নহে, নেতা-মন্ত্রীরা নানা উপায়ে বিভিন্ন কমিশনকে কুক্ষিগত করিতে চাহিয়াছেন। তাঁহাদের সফলতা নির্ভর করিয়াছে কমিশনের সদস্যদের উপর। সকল চাপ পরাহত করিয়া কমিশনের দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, এমন কমিশন-সদস্যের দৃষ্টান্ত কম নাই।

এই হতভাগ্য রাজ্যে আজ কি তেমন মানুষ কম পড়িয়াছে? পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে এই আশঙ্কা আরও গাঢ় হইল, কিন্তু সন্দেহের মেঘ ঘনাইয়াছে বহু দিন। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন নানা ঘটনার রিপোর্ট চাহিয়া পাঠাইতেছে, অথচ বিচার সম্পূর্ণ করিতেছে না, শাস্তির সুপারিশও করিতেছে না। বিচারপ্রার্থীর মনে হইতে বাধ্য, কমিশনের নিকট অভিযোগ করিয়া লাভ কী হইবে? রিপোর্ট তলব, তাহার পর আরও কিছু রিপোর্ট তলব, তাহার পর নীরবতা, ইহার অর্থ কী? আর পুলিশ-প্রশাসনের রিপোর্টের উপর এত নির্ভরতাই বা কেন? মানবাধিকার কমিশনের নিজস্ব তদন্ত দল রহিয়াছে, সদস্যদেরও তদন্তে যাইবার কথা। কিন্তু কী তদন্ত হইতেছে, তাহার কী ফল হইল, কেহ জানে না। শাসক দলের হিংসার সম্মুখে কমিশনের সদস্যরা সাক্ষীগোপাল সাজিয়া থাকিবেন, রাজ্যবাসী বিনা প্রশ্নে তাঁহাদের প্রণামী জোগাইবেন, এই কি প্রত্যাশা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE