ছবি: সংগৃহীত
দেখে মনে হচ্ছিল, হাঁটুছোঁয়া লম্বা ঘাসের মাঠ। কিন্তু পা বাড়াতেই দু’ফুট কাদায় গেঁথে গেলাম। ওগুলো আসলে এক ধরনের জলাভূমির ঘাস, যার ভেতরটা ফাঁপা, গাঁটগুলো হালকা পর্দা দিয়ে জোড়া, নাম চিরচিরা। যাঁরা খালি পায়ে ছিলেন, তাঁরা শামুক, গেঁড়ি, গুগলিতে খোঁচা খাচ্ছিলেন। ডিসেম্বরেও সেই সবুজের আস্তরণের নীচে এক ফুট জল। একটু নড়াচড়া করলেই জলে ছোট ছোট ঢেউ। ডাঙা থেকে দেখলে মাঠ, অথচ নামলে জল— কী আশ্চর্য জলাজমির এই জগৎ!
ডাঙায় থাকতে অভ্যস্ত মানুষের কাছে জলাভূমি মানেই জল। অথচ কিছু কিছু জলাভূমিতে সারা বছর মোটেও জল দাঁড়িয়ে থাকে না। কাদা, জলজ উদ্ভিদ এবং জলাভূমির সঙ্গে অভিযোজন হওয়া প্রাণীর উপস্থিতি— এই তিনটে থাকলেই তাকে জলাভূমি বলা যায়। এ দেশের জলাভূমি আইনে জলাজমি তাই ‘জলাভূমি’ বলেই স্বীকৃত। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রকাশনা ওয়েস্টল্যান্ড অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়া ২০১০ অনুসারে জলাজমি হল ‘পতিত জমি’। এক দিকে জলশক্তি মন্ত্রকের ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের জলাজমি সংশোধনের নির্দেশ, আর এক দিকে ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ ও ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর ‘পতিত জমি’কে উৎপাদনকারী জমিতে পরিণত করা— এই নীতিগুলির মাধ্যমেই জমি থেকে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়। অথচ, জমিই নয় জলাজমি। দুই আইনের অসঙ্গতি জলাজমিগুলোকে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
দামোদর ও রূপনারায়ণ নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় এক সময় বিস্তৃত জলাভূমি ছিল, যা এখন প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমে গিয়েছে, বর্তমানে তার এলাকা ১২০-১৫০ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। কেন এত সহজে এই জলাজমিগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সেই ইঙ্গিত আছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়েটল্যান্ডস অ্যান্ড ওয়াটার বডিজ় কনজ়ারভেশন পলিসি ২০১২’-র খসড়ায়। সরকারি দলিলে জলাজমিকে বহু সময় ‘শালী জমি’ বলে নথিভুক্ত করা হয়। তা হলে ফ্ল্যাট বা কারখানা তৈরি করতে কোনও বাধা থাকে না।
জলাজমির অনাদর অবশ্য নতুন নয়। ব্রিটিশ আমলেও তাকে বন্ধ্যা হিসেবে দেখা হত। সে আমলের বর্ণনায়, তরাইয়ের বিস্তীর্ণ জলাজমি ছিল ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত, মানুষের বাসের অযোগ্য, এবং উৎপাদন ক্ষমতা শূন্য। তাকে ‘সভ্যতা’র আওতায় আনতে চালু হয়েছিল সরকারি নীতি। স্বাধীনতার পর সবুজ বিপ্লবের জেরে তরাই অঞ্চল সঙ্কুচিত হতে হতে মূলের মাত্র দুই শতাংশ টিকে আছে। হারিয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীববৈচিত্র, জীবনশৈলী।
কী রকম? তার চর্চা এখনও টিকে আছে হাওড়া ও হুগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জলাজমি সংলগ্ন কিছু ছোট গ্রামে। সেখানকার বাসিন্দারা শীতকালে হোগলা কেটে নিয়ে গিয়ে ঘরের দেওয়াল আর ছাউনি বানান। জলাতেই তাঁরা ধুনচে গাছ লাগান, ফলে একফসলি জমিতেও ভাল চাষ হয়। খাওয়ার জন্য কুড়িয়ে নিয়ে আসেন জলার ফুল, শাক। এক সময় মিষ্টি জলের দিশি মাছও মিলত বছরভর, এখন যা পাওয়া দুষ্কর। এক কালে তাঁরা এখান থেকে প্রচুর শোলা সংগ্রহ করতেন। ইদানীং জলাজমি কমে আসার ফলে ক্রমশ দামি হয়ে উঠছে শোলা। তা ছাড়া জলার ঘাস গরু, বাছুর, ছাগলের সারা বছরের খাদ্য জোগায়। সেখানে দিনভর হাঁস, মুরগি চরে বেড়ায়।
জলাজমির সঙ্গে যে আমরাও যুক্ত, তার জীবনচক্র দেখলেই বোঝা যায়। বর্ষার শেষে জলে টইটম্বুর, তার পর মাটি আর ফাঁপা উদ্ভিদ সেই জল শুষতে থাকে, অর্থাৎ যে অতিরিক্ত জল সে বহন করছিল, তা সারা বছর ধরে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রীষ্মে তার মাটি খটখটে, অথচ নীচেই কাদা, তাতে অজস্র উদ্ভিদের বীজ। শুকিয়ে আসা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে অগভীর জল থেকেও যায়। কচুরিপানা, চিরচিরার মধ্যে জীবন্ত থাকে মাগুর, শিঙি, শোল।
সুতরাং, জলাজমি বুজিয়ে দিলে এলাকাবাসী সমস্যায় পড়বেনই। বালি-জগাছা ব্লকের বাসিন্দারা ভুক্তভোগী। আশেপাশে জলা কমতে থাকায় ওই অঞ্চল বর্ষায় ভয়ানক নোংরা হয়ে পড়ে। এক বাসিন্দা আন্দোলনও শুরু করেছিলেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন, এলাকায় যে দু’হাজার বিঘা জলাজমি রয়েছে, তার বড় অংশ বেআইনি ভাবে বুজিয়ে কারখানা এবং আবাসন তৈরি চলছে। এর জেরেই ২০১২ সালে তিনি খুন হন। এর পর কয়েকটি পরিবেশ সংগঠনের মামলার কারণে সেই কাজ আটকে গিয়েছে। সেই ব্যক্তির সৌজন্যেই ডানকুনি জলার কিছু অংশ এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছে।
২০১৭ সালে জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব রাজ্যগুলোর ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। আইন পাশ হওয়ার ২৪০ দিনের মধ্যেই প্রত্যেক রাজ্যের জলাভূমির নথি তৈরি করার কথা। তার মানচিত্র এত দিনে কেন্দ্রের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
বছর কয়েক আগে বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রজাতিকে রাজ্য-প্রাণীর আখ্যা দেয় রাজ্য সরকার: বাঘরোল— জলাজমির বাসিন্দা, মাছখেকো। তার পায়ের নীচ থেকেও ক্রমশ জমি সরে যাচ্ছে। শুধু বাঘরোল কেন? জলাজমি বোজানোয় নানা বিপর্যয়— বন্যা বা খরা ঘটলে বিপন্ন হব আমরা সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy