Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ডাইনোসর

মন্ত্রকের নির্দেশিকা, প্রসার ভারতীতে যে কর্মীরা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত, তাঁহাদের ছাঁটিয়া ফেলিতে হইবে। নির্দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিটি বর্তমান আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক।

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

স্মৃতি ইরানি নির্ঘাত তুমুল চমকাইয়াছেন। প্রসার ভারতীর বোর্ডও যে ফোঁস করিয়া উঠিতে পারে, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী তাহা ভাবিয়াছিলেন বলিয়া সন্দেহ হয় না। এক দিকে স্মৃতি ইরানি। মন্ত্রী হওয়া ইস্তক যাঁহার প্রধানতম কাজ ছড়ি ঘুরানো। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর কর্তালি করিতেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলির এক কালে তবুও স্বশাসনের অভিমান ছিল, সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধতা করিবার স্বভাব ছিল। স্মৃতির অভিজ্ঞতা বলিবে, ছাত্ররা যদিও বা প্রতিরোধ করিবার সাহস রাখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন— জরুরি অবস্থার সময়ের পরিচিত উপমায় বলিলে— ঝুঁকিতে হুকুম করিলে একেবারে শুইয়া প়ড়ে। এই দফায় তিনি যে ‘স্বশাসিত’ প্রতিষ্ঠানটির উপর খবরদারিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেই প্রসার ভারতীর ইতিহাসে প্রতিরোধ নাই। স্বশাসন তাহাদের নিতান্ত অলংকার— দেখিতে ভাল লাগে, কিন্তু খুলিয়া রাখিলেও ইতরবিশেষ হইবার সম্ভাবনা নাই। এহেন প্রতিষ্ঠানও যদি বলে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের নির্দেশিকা অতি আপত্তিকর এবং স্বশাসনের অধিকারের পরিপন্থী, স্মৃতি ইরানি স্বভাবতই চমকাইবেন। অনধিকারচর্চাই যে তাঁহার মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞান। প্রতিষ্ঠানকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব এবং মর্যাদা না দিলে যে সুশাসনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়, এই কথাটি তিনি, এবং তাঁহারা, বুঝিবেন বলিয়া আশা জাগে না।

মন্ত্রকের নির্দেশিকা, প্রসার ভারতীতে যে কর্মীরা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত, তাঁহাদের ছাঁটিয়া ফেলিতে হইবে। নির্দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিটি বর্তমান আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু, মন্ত্রকের বক্তব্য, প্রসার ভারতীর পরিচালনাগত ব্যয় কমাইয়া আনিবার যে সুপারিশ সাম পিত্রোদার নেতৃত্বাধীন কমিটি করিয়াছিল, এই নির্দেশিকা তাহারই অনুসারী। খরচ কমানো নিঃসন্দেহে জরুরি, কিন্তু তাহার জন্য একটি স্বশাসিত সংস্থার অধিকারে হস্তক্ষেপ করিবার প্রয়োজন পড়ে না। কত খরচ করা হইবে তাহা সরকার জানাইয়া দিক— সেই টাকায় পানতার জন্য নুনের ব্যবস্থা হইবে, না কি পোলাওয়ে ঘি পড়িবে, তাহা স্থির করিবার অধিকার প্রসার ভারতীর থাকাই বিধেয়। সরকার পয়সা দেয় বলিয়াই মন্ত্রীর খবরদারি করিবার অধিকার জন্মাইয়া যায় না, এই কথাটি স্মৃতি ইরানিরা যত দ্রুত বুঝিবেন, ততই মঙ্গল।

একটি বৃহত্তর প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রসার ভারতী নামক প্রতিষ্ঠানটির থাকিবার যৌক্তিকতা কী? একটি অনুগত প্রচারযন্ত্র হাতে থাকিলে শাসকের সুবিধা, তাহা অনস্বীকার্য— বিশেষত, তাহাদের যদি স্বৈরতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ থাকে, তাহা হইলে আরও বেশি সুবিধা— কিন্তু, সেই যুক্তিতে রাজকোষের টাকায় একটি প্রতিষ্ঠান পালন করা চলে না। সংবাদ বা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান অথবা বিনোদন, কোনওটির জন্যই ভারত আর সরকারের মুখাপেক্ষী নহে। বস্তুত, কেবল টেলিভিশনের কল্যাণে দূরদর্শন এখন বড় জোর দুয়োরানি। আকাশবাণীও ডাইনোসরপ্রায়। রাষ্ট্র নাগরিকের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও করিবে, এই ধারণাটি দুনিয়ার কোথাও বিংশ শতকের বেড়া টপকাইয়া একবিংশ শতাব্দীতে পা রাখিতে পারে নাই। প্রসার ভারতীর দিন গিয়াছে। তাহার বেসরকারিকরণ জরুরি। তাহাতে যদি দূরদর্শন বা আকাশবাণীর অপমৃত্যু ঘটে, যদি তাহা স্মৃতির (ইরানি নহে) অতলে তলাইয়া যায়, তাহাকে নিয়তি বলিয়া মানিয়া নেওয়া ভিন্ন উপায় কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prasar Bharati Smriti Irani I & B Ministry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE