অক্লান্ত: নতুন বছরেও প্রতিবাদে অনড় কৃষিজীবীরা। দিল্লির গাজ়িপুর সীমান্তে কৃষক-অবস্থান। ২ জানুয়ারি, ২০২১। পিটিআই
বয়-স্কাউটদের প্রতি দিন অন্তত একটি ভাল কাজ করতে হয়। দিনের শেষে দলপতি এক সদস্যকে শুধোন, “আজ কোনও ভাল কাজ করতে পেরেছ?”
“হ্যাঁ।”
“বাহ্। কাজটা কি কঠিন ছিল?”
“হ্যাঁ, বেশ কঠিন।”
“কেন? কী করেছিলে তুমি?”
“এক দৃষ্টিহীন মানুষকে রাস্তা পার করিয়েছি।”
“খুব ভাল কাজ। কিন্তু কাজটা কঠিন হল কেন?”
“তিনি রাস্তা পার হতে চাননি যে।”
চুটকিটি মনে পড়ে গেল কৃষি বিল পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা নিয়ে ভাবতে বসে। সরকারপক্ষ যখন রাস্তা কেটে, হাড় হিম করা ঠান্ডায় জলকামান দেগে কৃষকদের দিল্লি অভিমুখে যাত্রা থামাতে ব্যর্থ, তখন রাজদণ্ড নামিয়ে দু’দণ্ড ভাবলে হয়তো বুঝতে পারত তাদের যুক্তির উদ্ভটত্ব। যাঁদের ভালর কথা ভেবে এত কাণ্ড, তাঁরাই বলছেন যে, আমরা তোমাকে এমন উপকার করতে তো বলিনি! অথচ সরকার বার বার বলে চলেছে যে, এতে কৃষকেরই উপকার হবে।
কিছু অর্থনীতিবিদ আবার ‘বৃহত্তর স্বার্থ’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এঁরা মনে করেন যে, গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে যে সংস্কার তরতরিয়ে এগোচ্ছিল, কৃষিতে তা তেমন ঢুকতে পারেনি। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, সরকারি ক্রয়, ফুড কর্পোরেশন, ভর্তুকি— সব মিলিয়ে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রটি এমনই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, তার সংস্কার না করলেই নয়। সাম্প্রতিক কৃষি আইনের ফলে সেই সংস্কার কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল বলেই তাঁরা মনে করেন। আর এই মহৎ অগ্রগতিতে যাঁরা বাধা দিচ্ছেন, তাঁরা তা করছেন নিজেদের ‘ক্ষুদ্র স্বার্থ’-এর দিকে তাকিয়ে, কারণ তাঁরা কেউ গরিব কৃষক নন। অনেকেই তো আসলে ফড়ে— মাখনটা খেয়ে যাচ্ছেন। অতএব, তাঁরা যে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি, তা বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এখানে বলে রাখা ভাল, কৃষিতে যে যথাযথ সংস্কারের প্রয়োজন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। স্থিতাবস্থায় সামগ্রিক কল্যাণ নেই। প্রশ্নটা হচ্ছে, কেমন সংস্কার, এবং তাতে কার লাভ কার ক্ষতি। হিসেবটি আন্দাজে না থাকলে সংস্কারপন্থা ও তার বিরোধিতার ধরনটিও বোঝা যাবে না।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, এই কৃষি আইনে গরিব কৃষকের উপকার হবে, পঞ্জাব হরিয়ানার সম্পন্ন কৃষকেরা সেই আনন্দে উদ্বাহু হয়ে নিজেদের তথাকথিত ‘ক্ষুদ্র স্বার্থ’ বিসর্জন দিতে যাবেন কেন? সরকারি আধিকারিক বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষকদের যদি প্রস্তাব দেওয়া হত যে, দেশের-দশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে তাঁদের বেতন বৃদ্ধির মতো ‘ক্ষুদ্র স্বার্থ’ পরিত্যাগ করতে হবে, তাঁদের প্রতিক্রিয়াটি কেমন হত, জানতে ইচ্ছে হয়!
কথাটা হচ্ছে ভাগ-বাঁটোয়ারার রাজনীতি নিয়ে। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ থেকে সিংঘুতে কৃষকদের জমায়েত— বণ্টনের ন্যায্যতার প্রশ্নটিই আদতে এমন আন্দোলনগুলির মর্মবস্তু। অনুমান করি যে, এমন আন্দোলন আরও হবে। খেটেখুটে, জোট বেঁধে, চাপ দিয়ে, সরকারি সংগ্রহ-নীতির যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করে, পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকেরা যে স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করেছেন, তা তাঁরা ছাড়তে চাইবেন কেন? তাঁদের চোখে এই সংস্কার অন্যায্য। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের চেতনায় ন্যায্যতার বিষয়টি কী ভাবে রয়েছে, তার উপর নির্ভর করছে সরকারি নীতির বিরোধিতার তীব্রতা। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রকৃতি অনুধাবন না করে, কৃষিপণ্যের বাজার মুক্ত করলে সকলেরই লাভ— এ জাতীয় তথাকথিত আর্থনীতিক যুক্তির বালখিল্য পুনরাবৃত্তি এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
বণ্টনের রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে, সাম্প্রতিক কৃষি আইন এবং শ্রম আইনের মধ্যে একটা যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে। শ্রমিকদের একটি ছোট্ট অংশ এত কাল যে সুযোগ-সুবিধাগুলি পেয়ে আসছিলেন, তা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন ও চাপের ফলে সম্ভব হয়েছিল। শ্রমিকদের সব অংশের মধ্যে সেই সুযোগগুলি কেন বিস্তার লাভ করল না, বা কী ভাবে তা সম্ভব হতে পারে, সেই ভাবনাটিই হতে পারত স্বাভাবিক পরবর্তী ধাপ। কিন্তু একাংশের অর্জিত সুবিধাগুলিকে প্রগতির চরম বাধা হিসেবে দেগে দিয়ে, আইন করে কেড়ে নিয়ে, সবাইকে একই স্তরে নিয়ে এলে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে, এবং শ্রমিকদের সামগ্রিক কল্যাণ হবে, এ যুক্তি স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। ঠিক তেমনই, সম্পন্ন কৃষকদের ‘সুবিধাভোগী শ্রেণি’ বলে দিয়ে অর্জিত সুবিধাগুলি সরিয়ে নিয়ে ‘নতুন আইনে সামগ্রিক ভাবে কৃষকশ্রেণিরই ভাল হবে’ ঘোষণা— এমন কথাও ওই কৃষকদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। মিল পাওয়া যাচ্ছে না?
ভর্তুকির ‘বোঝা’ নিয়ে উদ্বেগও এই বণ্টনের রাজনীতিরই আর এক মাত্রা। কৃষিতে ভর্তুকির কথা উঠলেই তাকে বলা হবে ‘বোঝা’, আর শিল্পের জন্যে জলের দামে জমি দেওয়াকে বলা হবে ইনসেন্টিভ— এমন যুক্তি অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায় না। সামগ্রিক ভাবে কৃষিক্ষেত্র যে সঙ্কটে ভুগছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই— কারণ কৃষিকাজ আর তেমন লাভজনক নয়। তবু কৃষি উৎপাদনের যেটুকু বৃদ্ধি হচ্ছে প্রতি বছর, তা ওই লাভের-মুখ-না-দেখা কৃষকদের শ্রমের ফসল। জমির উৎপাদনশীলতা অনেকটা বাড়াতে গেলে শ্রমের পাশাপাশি অন্য উপাদান লাগে, তাতে খরচ বাড়ে, অথচ ফসলের দাম সেই তুলনায় বাড়ে না। এটাই সামগ্রিক চিত্র, পঞ্জাব-হরিয়ানার সম্পন্ন কৃষকেরা খানিক ব্যতিক্রমমাত্র। ফলে কৃষি উৎপাদন চালিয়ে যেতে গেলে ভর্তুকি থাকতেই হবে। ঠিক যে যুক্তিতে শিল্পে থাকে ইনসেন্টিভ, বা যে যুক্তিতে শিক্ষকদের বেতন তাঁদের বাজারদরের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ব্যাপারটা আর একটু খোলসা করে বলি। পুরোপুরি বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে যুক্ত মানুষের আয় কম-বেশি নির্ভর করে সেই ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতার উপর। আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের আয়ের ঊর্ধ্বসীমা সেই ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা দ্বারা নির্ধারিত। এক জন কর্মী যদি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের উৎপাদন করেন, তা হলে তাঁর বেতন যত দূর পর্যন্ত উঠতে পারে, যিনি দশ হাজার টাকা মূল্যের উৎপাদন করছেন, তাঁর বেতন অত দূর উঠতে পারে না। তথ্যপ্রযুক্তিতে এক জন কর্মী যে পরিমাণ মূল্য উৎপাদন করেন, এক জন কৃষক বা হস্তশিল্পী তা পারেন না বাজারের নিয়মেই। ফলে দু’জনের আয়ের পার্থক্য হয়ে যায় বিশাল। তা হলে এক জন অধ্যাপকের বা চিকিৎসকের আয় নির্ধারিত হয় কী নিয়মে? অবশ্যই বাজারের নিয়মে নয়। আজ সব অধ্যাপককে যদি ছাত্রছাত্রীদের থেকে আদায়ীকৃত অর্থ থেকে আয় করতে হত, তাঁদের আয় নেমে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, বলা মুশকিল। প্রযুক্তির উন্নতিতে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ে, বেশির ভাগ সেবাক্ষেত্রে তেমন বাড়ে না, যেমন স্বাস্থ্য বা শিক্ষায়। ফলে এ সব ক্ষেত্রে নিযুক্তদের আয় উত্তরোত্তর বাড়াতে গেলে তা বাজার ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে অসম্ভব। তাই রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করে রেখেছে। ছাত্রসংখ্যা কমলেও অধ্যাপকদের বেতন কমে না।
রাষ্ট্র-প্রদত্ত নিরাপত্তার ছত্রচ্ছায়ায় বসে অন্যকে বাজারের অনিশ্চিত স্রোতে ঠেলে দিয়ে যদি বলি, এ তোমার ভালরই জন্যে— সে অধিকার আমি পেলাম কোথায়? বাজার ক্ষেত্রবিশেষে সুযোগ ও পছন্দের স্বাধীনতা বাড়ায়, তাই অন্ধ বাজার-বিরোধিতার মানে নেই। কিন্তু বাজারে যদি কৃষক নিরাপত্তার অভাব দেখেন, আর কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তার লক্ষ্যে
যদি আন্দোলনে নামেন, তাঁকে কোন অর্থনীতির যুক্তিতে আমি বলতে পারি যে, আপনি বৃহত্তর স্বার্থ দেখছেন না? আসুন, আপনাকে কৃষি আইনের উপকারিতা বোঝাই?
বর্তমানের বণ্টন ব্যবস্থা— যা ঠিক করে দেয় কার কী প্রাপ্য— যেন প্রচ্ছন্ন এক সামাজিক চুক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। আপেক্ষিক ভাবে বেশি নিরাপদ শ্রেণি যদি ধরে নেয় যে এই সামাজিক চুক্তি চিরস্থায়ী, তা হলে ভুল হবে। বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে যে ন্যায্যতার বোধ রয়েছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সামাজিক চুক্তির স্থায়িত্বের। সংস্কারের মধ্যে যেগুলি মোটের উপর ভাল, সেগুলিও অধরা থেকে যাবে, যদি সামাজিক চুক্তির উপর আস্থাই চলে যায় নাগরিকের বৃহত্তর অংশের। তাই কৃষি আইনের প্রশ্নটি আইন বা অর্থনীতির নয়, এটি সভ্যতার প্রশ্ন।
নির্দেশক, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy