Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাগর ও গোষ্পদ
Lok Sabha Election 2019

বিদ্যাসাগরের ভাবমূর্তি তো চুরমার হয়েই চলেছে

রাজনীতির আখড়ায় শরীর গরম করতে নেমে স্কুলের লেখাপড়ার ও-সব তলানি ঘাঁটতে ভাল লাগে? এ দিকে যতই শাস্ত্র পড়ে থাকুন, তেমন ধার্মিক ছিলেন না, শেষে তো রীতিমতো নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন।

 পরিণতি: উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তির ধ্বংসাবশেষ। ১৪ মে ২০১৯। ছবি: সুমন বল্লভ

পরিণতি: উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তির ধ্বংসাবশেষ। ১৪ মে ২০১৯। ছবি: সুমন বল্লভ

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বিদ্যাসাগরের একান্ত স্বকীয় মহিমা নিজের কাছে বোঝাতে আমি মনে মনে একটা উদ্ভট মাপকাঠি প্রয়োগ করি: বাংলার নবজাগরণের মনীষীদের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই আজকের রাজনীতিকরা কব্জা করতে পারেননি। বিবেকানন্দের তো বলেকয়ে ধর্মীয় পরিচিতি, তিনি কবে হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছেন। রামকৃষ্ণের আশ্চর্য উপস্থিতি দেখেছি অধুনা প্রয়াত এক বাম নেতার নির্বাচনী পথনাটকে। রবীন্দ্র-বঙ্কিমের চিন্তার উড়ো ধূলিকণায় অনেকেই পরিবেশদূষণ ঘটায়। একমাত্র বিদ্যাসাগর এই বিষভক্তি থেকে রেহাই পেয়ে এসেছেন এত দিন।

তার প্রধান কারণ, বিদ্যাসাগর বড্ড বোরিং। কবিতা-গান-গল্প-নাটক নয়, লিখেছেন কতক স্কুলপাঠ্য বই আর পণ্ডিতি অংবং— ছোটদের বইগুলোতেও ভীষণ অংবং। রাজনীতির আখড়ায় শরীর গরম করতে নেমে স্কুলের লেখাপড়ার ও-সব তলানি ঘাঁটতে ভাল লাগে? এ দিকে যতই শাস্ত্র পড়ে থাকুন, তেমন ধার্মিক ছিলেন না, শেষে তো রীতিমতো নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন। সনাতন সমাজের অন্যায়-অমঙ্গল নিয়ে শুধু ভেবেছেন নয়, শোধরাতে গিয়ে ভারতের মহান ঐতিহ্যের প্রচুর ক্ষতি করেছেন। জীবৎকালে সে জন্য গাল জুটেছে কম নয়, মার অবধি খেয়েছেন। বলা চলে, সে কালের রাজনীতি তাঁকে রেহাই দেয়নি। কিন্তু আজ ওই সব অচল মাল চালিয়ে কেউ বাজার নষ্ট করে?

হালের রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে দু’বার। প্রথমটা ঠিক রাজনীতি নয়— সাক্ষরতা ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে তাঁদের একদা বাৎসরিক উৎসবকে বামেরা নাম দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মেলা। অন্য স্মৃতিটা সুখকর নয়। নকশাল যুগেও তাঁর মূর্তির মাথা কাটা গিয়েছে। আদি মাওবাদীরা ঠিক বুঝেছিল, অনেক বিপ্লব ঘটালেও লোকটা আসলে কত বড় প্রতিক্রিয়াশীল। মঙ্গলবারের ঘটনার মধ্য দিয়ে অর্ধশতক আগের অতি-বামেদের সঙ্গে আজকের অতি-দক্ষিণীরা একাকার হয়ে গেল।
তফাতটাও কিন্তু মৌলিক। মাওবাদীরা কাজটা করেছিল ভেবেচিন্তে। বাংলার যে শিক্ষাধারা বিদ্যাসাগর পুষ্ট করেছিলেন, তার জোরেই তারা লাল কেতাব পড়ে তাঁকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়েছিল। এ বার কিন্তু বিদ্যাসাগর নেহাত পার্শ্বচরিত্র— দুষ্কৃতীর আক্রমণের মুখে দৈবাৎ পড়ে গেলেন, দাঙ্গার মধ্যে নিরপরাধ পথচারীর মতো। কোনও নেতৃকুল তাঁকে মুণ্ডপাতের খাতিরটুকু অবধি দেখাননি। তিনি স্রেফ অবান্তর হয়ে গিয়েছেন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এমনটা সন্দেহের অবকাশ বরাবর ছিল। নিরন্তর অসংখ্য নজিরের মধ্যে চুটকি দু’চারটে তুলে ধরছি। ২০১৬ সালেও রাজ্যের ৪ শতাংশ প্রাথমিক স্কুল চলছিল এক জন মাত্র শিক্ষক নিয়ে। এ বছর শোনা গেল মেয়েদের একটি মাধ্যমিক স্কুলের কথা, যেখানে এক জনও পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নেই। ‘প্রথম’ সংস্থার প্রামাণ্য রিপোর্টে প্রকাশ, ২০১৮’য় পশ্চিমবঙ্গের মাত্র অর্ধেক পঞ্চম শ্রেণির ছেলেমেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির উপযোগী পাঠ্য মাতৃভাষায় পড়তে সক্ষম; সারা ভারতে আরও কম, ৪৪ শতাংশ। সরল ভাগের অঙ্ক করতে পারে পঞ্চম শ্রেণিতে যথাক্রমে ২৯ ও ২২ শতাংশ। সব সংখ্যাই ২০১০ সালের তুলনায় কম, যেমন কম গ্রামীণ প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের হাজিরা। এমন পরিসংখ্যানের শেষ নেই, ফি-বছর অনেক রিপোর্টেই আমরা পড়ি বা চাইলে পড়তে পারি। মতি হলে তখনই বোঝার কথা, বিদ্যাসাগরের ভাবমূর্তি চুরমার হয়েই চলেছে; জোড়া লাগাবার তাগিদে মিটিং-মিছিল দূরে থাক, একটা আওয়াজও আমরা তুলিনি।

কেন্দ্রের বর্তমান শাসকেরা বলতে গেলে অবিদ্যার সাধনা করছেন, সেটা বোঝার জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ নেতার অপবৈজ্ঞানিক দৃপ্ত উক্তিগুলিই যথেষ্ট। কিন্তু অন্যত্র সৎ উদ্যোগেও বিদ্যাসাগরকে মনে পড়ে কই? কন্যাশ্রী নামে যে ফলপ্রসূ প্রকল্প রাজ্য জুড়ে চলছে, উনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষার এই প্রবক্তা তাকে আশীর্বাদ করতেন মনে হয়। সেই অর্থে তাঁকে কন্যাশ্রীর অনুপ্রেরণা বলে অবশ্যই ভাবা যেত; কিন্তু তা নিয়ে এত ঢক্কানিনাদের মধ্যে এক বার তাঁর নাম শোনা গিয়েছে কি, একটা হোর্ডিংয়ে দেখা গিয়েছে তাঁর ছবি? তিনি প্রাসঙ্গিক হলেন, যখন দৈবাৎ একটা হিংসার ঘটনায় দুই রাজনৈতিক দল তাঁর নাম করে কাজিয়া লড়ার নতুন সুযোগ পেল।
শুধু রাজনীতিকদের দুষলে চলবে না। এই ঘটনার পর আমরা সরব হয়েছি বটে; কিন্তু শিক্ষা ও সমাজের যে অধঃপতনে এমনটা ঘটতে পারে, তাতে আমরা ধারাবাহিক ভাবে নিশ্চুপ থেকেছি, পরশু দিন থেকে আবার থাকব। মূর্তি ভাঙার ঘটনায় গোটা অবস্থার একটা বেআব্রু প্রতীক বা রূপক সৃষ্টি হল, তাতে আমরা কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছি এই যা।

আধুনিক কালে বিদ্যাসাগরের আর একটা উল্লেখ আমাদের মনে পড়তে পারে। সেটা সিনেমার পর্দায়— সব চরিত্র কাল্পনিক। সত্যজিতের ছবিতে তৎকালীন শাসকের প্রতিকৃতির সামনে বসে এক নেতা মগজ হাতড়াচ্ছেন মহাপুরুষের নামের খোঁজে, মনে পড়ছে কেবল বিদ্যাসাগর। শিক্ষা-সমাজ-সততার কিছুই লোকটা জানে না; সেই অজ্ঞাত বিপরীত জগতের প্রতিনিধি হিসাবে স্মৃতির সম্বল শুধু বিদ্যাসাগরের নাম। সেটাও একটা স্বীকৃতি বটে। এর বেশি না হলে এক অর্থে স্বস্তি— কাজ নেই তাঁর রাজনৈতিক ছেলেধরাদের পণবন্দি হয়ে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE