Advertisement
E-Paper

রাজনীতির আঙিনায় আজও আঁধারে বহু মহিলা

মহিলা জনপ্রতিনিধিকে ক্ষমতা দেওয়া হল। কিন্তু তাঁকে সেই ক্ষমতা বহন করার উপযুক্ত করা হল না। তাঁকে পথ দেখান তাঁরই পরিবারের এক পুরুষ অভিভাবক। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামমহিলা জনপ্রতিনিধিকে ক্ষমতা দেওয়া হল। কিন্তু তাঁকে সেই ক্ষমতা বহন করার উপযুক্ত করা হল না। তাঁকে পথ দেখান তাঁরই পরিবারের এক পুরুষ অভিভাবক। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৫

অমর্ত্য সেন বলেন, ‘মহিলাদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ মেয়েদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে হীন করেছে।’ আসলে সমাজ এখনও পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের মাঝের দাগটা স্পষ্ট দেখে না। পক্ষপাত করতে কেউ শেখায় না। আবহমান কাল ধরে যা হয়ে আসছে তাকেই বহন করে সবাই মিলে। পরিবারে মহিলাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা নেই। সমাজে নিজের মত প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই।

রাজনীতিতে কোনও মহিলা ধূমকেতুর মতো এসে পড়লে তাঁর কাছে খুব বেশি কিছু আশা করা যায় না। এখন রাজনীতিতে মেয়েদের আনা হয় প্রত্যাশা থেকে নয়। ক্ষমতা তুলে দিতেও নয়। শুধু ‘কোটা’ পূরণের দায় থেকে। বংশপরিচয় বা স্বামীর পরিচয় সেখানে বড় ভূমিকা নেয়। ক্ষমতাকে বহন করার জন্য একটা দাপট দরকার হয়। সেই দাপট অর্জন করার ক্ষমতা আসে পরিবার ও সমাজের ভিতর থেকেই। মহিলাকে ক্ষমতা দেওয়া হল পঞ্চায়েতে। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে বহন করার উপযুক্ত করা হল না মহিলা জনপ্রতিনিধিকে। তাই তাঁকে পথ দেখানোর জন্য রয়ে গেলেন তাঁর পরিবারের এক পুরুষ অভিভাবক।

তাই ক্ষমতা ধারণ করে লক্ষ্যে পৌঁছনোর ইতিহাস এক পা-ও এগোল না। পিছিয়ে থাকাটা এক ধারাবাহিক পরিক্রমায় পরিণত হল। ২০১৮ সালের এক নির্বাচন সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেল, মহিলা প্রতিনিধি দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি কম দুর্নীতিপরায়ণও বটে। রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে খানিকটা বিযুক্ত। মেয়েদের নির্বাচনে যোগদান বিগত দশ বছরে বেড়েছে। অনেকে একে ‘ফেমিনাইজেশন অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ভোট দেওয়ার বাইরে বাকি রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও নির্বাচনী বিষয় নিয়ে বেশিরভাগ মেয়েরা কিন্তু অন্ধকারেই।

স্বাধীনতার পরে প্রতি নির্বাচনেই নতুন আশ্বাস। এত দিন যা হয়েছে তা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখায় রাজনৈতিক দল ও নির্বাচিত সরকার। অসাম্যের নীতি বর্জন নয়, অনুকরণ এবং মহিলাদের উন্নয়নের রাজনৈতিক চমকই প্রধান হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এ দেশকে নিয়ে যে জায়গায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন তা হয়নি। তার কারণ রাজনৈতিক প্রতারণা ও সেই প্রতারকদের শাস্তি দেওয়ার অভাব। এক বিরাট সংখ্যক মহিলাদের সংহত না করার প্রবণতায় কখনও ধিকৃত হননি নির্বাচিত পুরুষ জনপ্রতিনিধিরা।ভোটের জন্য এলাকায় গিয়েছেন, পুরুষদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন, চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে রান্না করতে দেখে খুশি হয়ে ফিরে এসেছেন। সেই মহিলারাই সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে নিজের ব্যবসা বা উপার্জনে লাগাচ্ছেন না। স্বনির্ভরতার শর্ত বিসর্জন দিয়ে স্বামীর নির্দেশে টাকা ঋণ নিয়ে মেয়ের বিয়েতে খরচ করছেন।

স্বনির্ভরতার এই অপপ্রয়োগ আসলে গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্ধকারের অতলে তলিয়ে দিচ্ছে। এটুকু বোঝানোর দায় নেতারা মাথায় তুলে নিচ্ছেন না। এলাকায় এক বিরাট অংশের মহিলাদের গণতান্ত্রিক চেতনা ফেরানোর কাজটা নেতারা দায়িত্বের তালিকায় রাখেননি। মহিলাদের ভোট পেতে গেলে পরিবারের পুরুষের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা যথেষ্ট বলেই
তাঁরা জানেন।

জনপ্রতিনিধিদের উচিত এলাকায় মেয়েদের ঐক্যবদ্ধ করে পাচার, ইভটিজিং, চোরাকারবার, পণের মতো বিষয়গুলো বন্ধ করা। কিন্তু এই নৈতিক বিষয় নিয়ে মানুষের সমস্বর নির্মাণে কখনও ব্রতী হন না নেতারা। প্রশ্ন হল, জনগণের স্বপ্ন ও আবেগের সঙ্গে ডাকাতি করেও জনপ্রতিনিধিরা কি লজ্জিত? সমাজ তাঁদের ব্রাত্য করে না। পিছু হটছে দেশের অন্তর্নিহিত শক্তি। যাঁদের কথা ছিল পার্লামেন্টে গিয়ে আইন তৈরি করে দেশের মূল ধারায় পরিবর্তন আনা, তা তো হলই না, বরং তাঁরা প্রচলিত বিশ্বাস বা সংস্কারকেই শক্ত করলেন। মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের দাম বা পেট্রলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সকলেই কেমন বন্ধু হয়ে যান। নিয়ম তৈরি হয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সুবিধার্থে। মেয়েদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হয় না। তাঁদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও পারিবারিক হিংসা নিয়ে যে আইনি শিথিলতা তা নিয়েও কোনও প্রশ্ন তোলা হয় না।

চার্লস ফুরিয়ার প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোনও একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান। দেশের শাসকেরা শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশ পরিচালনা করে থাকেন, কখনও বা দলীয় স্বার্থে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের চিন্তা তাঁরা কখনই করেন না। সেটা করলে অবশ্যই মহিলাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার নতুন প্রয়োগ ঘটত। গত দশ বছরে দেশের মোবাইল, বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিয়ো, পত্রিকা, ইন্টারনেটের দৌলতে এখনকার মানুষ আগের তুলনায় অনেক বিষয়ে সচেতন। মানুষ সমাধান চায়, পরিবর্তন চায়। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য মেয়েদের সচেতন করার প্রয়াস নেতার একার হতে পারে না। এই অজুহাত তুলে তাঁরা এড়িয়ে যান।

এমন এক রাজনৈতিক দল বা সরকার সকলেই চায় যারা মহিলাদের বেকারত্ব নিয়ে ভাববে। তাঁদের শুধু টুপি, ফুলদানি, চাদর তৈরির বাইরেও মেধার প্রয়োগ হয় এমন ক্ষেত্রে বড়সড় সাফল্যের স্বপ্ন দেখাবে। এবং তাঁদের যোগ্যতার সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করবে। সরকারের সদর্থক ভূমিকা মহিলাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের রক্ষাকবচ। কিন্তু সরকার তো ইট, কাঠ, পাথরের নয়, মানুষের। সেই মানুষ যাঁরা মহিলা নেত্রীদের মধ্যে দুর্বলতা, নির্ভরশীলতা আবেগময় নারীত্ব চান।

তাই এলাকা খুঁজে প্রথমেই বের করা হয় সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা ব্যক্তির স্ত্রীদের। স্ত্রীর নামে সেই ব্যক্তিই চালাবেন যাবতীয় কাজ। মনোনয়ন দাখিল থেকে নির্বাচনী প্রচার ও গণনায় প্রার্থীর অভিভাবক উপস্থিত। আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতলেও দলের লোকজনকে আবির মাখানো ও মিষ্টিমুখের কাজটাও করে থাকবেন সেই মহিলার স্বামীই। মহিলা শুধু হাসিমুখে ঘোমটা দিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করে চলবেন। অনেক সময় মঞ্চে বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন মহিলা প্রধানের স্বামী। অনেক সময় আবার মন্ত্রিসভায় তাঁরাই ঠাঁই পান যাঁদের নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করা সহজ। অনেক সময় সেই মহিলার মাথায় থাকে কোনও ‘হেভিওয়েট’ নেতার আশীর্বাদের হাত। তাঁর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়া সেই নেত্রীর কিন্তু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয় না।

রাশিয়ায় বিপ্লবের আগে ও পরে মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে একটি নোট প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে মেয়েদের জীবনকে কাজের নিরিখে কতগুলি ভাগে ভাগ করা হয়। শিক্ষা, পরিবার, গার্হস্থ্য জীবন, কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতি। বিপ্লবের আগে বিবাহিত মেয়েদের বাইরে উচ্চ মানের কাজ দেওয়া হত না। যেন তাঁরা বাড়িতে সংসার ও সন্তানের দিকেই বেশি আগ্রহী হন। বিপ্লবের পরে দেখা গেল তানিয়া নামে এক মেয়ের উপরে এসে পড়েছে কাজের ব্যাপক ভার। ঘরের কাজে, সংসারে তাঁর কোনও সাহায্যকারী হাত নেই। আবার বাইরে কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয়তা অব্যাহত। তানিয়াকে ক্ষমতা অর্জনের উপযুক্ত করে তোলার দায় পরিবার, সমাজ, দল, সরকার সকলের।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

Politics Politician Women
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy