Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্যানসারের সঙ্গে কঠিন লড়াই চলছে

প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গহীন। আক্রান্ত অঙ্গ থেকে ক্যানসার কোষ নিঃশব্দে অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সারা বিশ্বে অসুখে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ক্যানসারের স্থান দ্বিতীয়, হার্টের অসুখের পরেই। বিশ্ব ক্যানসার দিবসে লিখছেন অরুণাভ সেনগুপ্তপ্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গহীন। আক্রান্ত অঙ্গ থেকে ক্যানসার কোষ নিঃশব্দে অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সারা বিশ্বে অসুখে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ক্যানসারের স্থান দ্বিতীয়, হার্টের অসুখের পরেই।

ভিড়। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। —ফাইল ছবি।

ভিড়। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। —ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৬:০৯
Share: Save:

মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অসুখের ইতিহাসও। ক্যানসারের অস্তিত্বও পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাসে।

১৮৬২ সালে এডউইন স্মিথ নামের এক স্বঘোষিত মিশর গবেষক একটি ১৫ ফুট লম্বা প্যাপিরাস উদ্ধার করেন। অনুবাদে দেখা যায়, তাতে লিপিবদ্ধ আছে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬২৫-এ মিশরের এক চিকিৎসক, ইমহোটোপের চিকিৎসার বিবরণ। বিস্ময়করভাবে এই বিবরণ আধুনিক শল্য-চিকিৎসা বিদ্যার নথির মতোই বিশদ। এতে ৪৮টি ‘কেস’ এর বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ তম ‘কেস’টি স্তনের টিউমার নিয়ে। নিখুঁত বর্ণনা। কিন্তু, অন্য ‘কেস’গুলির চিকিৎসা লেখা থাকলেও ইমহোটোপ এখানে একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন, ‘‘এর কোনও চিকিৎসা নেই।’’ ইমহোটোপের এই অসহায়তা ভবিষ্যতেও প্রতিধ্বনিত হবে।

এর পরে ক্যানসারের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে আরও দু’হাজার বছর পরে। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ অব্দে লিখলেন, সাইরাস কন্যা, এটোসা-র কথা। পার্সিয়ার সাম্রাজ্ঞী এটোসা আক্রান্ত হয়েছিলেন রক্তক্ষরণকারী স্তনের ক্যানসারে। নিজেকে এবং কষ্টকে সবার চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখতে অবশেষে স্তন বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনাতেও আবিষ্কৃত হয়েছে আদি ক্যানসারের অস্তিত্ব। যেমন, আদিমতম মানুষের কঙ্কাল ‘লুসি’-র আবিষ্কর্তা প্রত্নতাত্ত্বিক লুইস লিকি খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছরের একটি চোয়ালের হাড় আবিষ্কার করেছিলেন। যাতে ছিল ‘লিম্ফোমা’ ধরনের ক্যানসারের চিহ্ন। তবে ইতিহাসে ক্যানসারে উদাহরণ কম পাওয়ার কারণ, এটি প্রধানত বেশি বয়সের অসুখ। আর আদিম মানুষের আয়ুই ছিল কম। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের আয়ুকে বাড়িয়েছে। ফলে, ক্যানসারের সংক্রমণ চোখে পড়ছে বেশি। রোগনির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতিও রোগটিকে আড়ালে থাকতে দিচ্ছে না।

‘ক্যানসার’ নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কার্কিনো’ থেকে। যার অর্থ কাঁকড়া। নামটি নাকি দিয়েছিলেন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০)। ক্যানসারের কারণ হিসেবে, হিপোক্রেটিসের ‘কালো পিত্তের বৃদ্ধি’র তত্ত্ব বহুদিন চালু ছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দেখা গেল, ক্যানসারের কারণ লুকিয়ে আছে মানবকোষেই। কিছু কোষের বিভাজন, বৃদ্ধির নিয়ম ও শৃঙ্খলকে ভেঙে দিলে ক্যানসারের সৃষ্টি হয়। কোষের ভেতরে আছে ‘জিন' যা বংশধারার কার্যকরী একক। এটি তৈরি ‘ডিএনএ’ দিয়ে। ক্যানসারে এই ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জিনের ‘মিউটেশন’ বা বিকারগত পরিবর্তন ঘটে। আমাদের কোষে আছে স্বাভাবিক জিন, ‘প্রোটোঅঙ্কোজিন’। এদের মিউটেশন হলে তৈরি হয় ‘অঙ্কোজিন’। যা স্বাভাবিক কোষকে ক্যানসার-কোষে পরিণত করে। আবার কোষে ‘টিউমার সাপ্রেসর জিন’ও আছে, যা কোষ বিভাজন, ডিএনএ-র মেরামতি এবং তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করে। মিউটেশনের পরে ক্যানসার কোষ টিউমার সাপ্রেসর জিনকেও অস্বীকার করে। তারই সঙ্গে সঙ্গে অবিরাম বিভাজিত হতে হতে অস্বীকার করে মৃত্যুকেও।

কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাহ্যিক পরিবেশগত উদ্দীপক থেকে। এদের বলা হয় ‘কার্সিনোজেন’। অ্যাসবেস্টস, নিকোটিন, এক্স-রে— এমন শতাধিক কার্সিনোজন চিহ্নিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে বংশধারাই বহন করে চলে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ সমন্বিত জিন। যেমন, স্তনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-২ জিন। হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি জানতে পারেন, তিনি বহন করছেন বিআরসিএ-১ জিন। তাঁর মা মার্সেলিন বারট্রান্ড ৫৬ বছর বয়সে স্তনের ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। একই রোগে মারা গিয়েছিলেন জোলির মাসিও। জোলির স্তন ক্যানসারে আশঙ্কা ছিল শতকরা ৮৭ ভাগ। তাই ২০১৩ সালে জোলি স্তন বাদ দিয়ে ছিলেন। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল কৃত্রিম স্তনও। যদিও তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কারণ, অনেকের মতে এ ব্যাপারে চিকিৎসা বা নজরদারির একটি ভূমিকা আছে।

আবার ক্যানসার সৃষ্টিতে ভূমিকা আছে কিছু ভাইরাসেরও। যেমন, লিভার ক্যানসারে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, ইউটেরাস, সার্ভিক্স ইত্যাদির ক্যানসারে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, নন-হজকিন্স লিম্ফোমায় ইপি স্টেইন-বার ভাইরাস।

ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা অনেক। প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গহীন অবস্থার জন্য রোগনির্ণয়ে সময় লাগে। তা ছাড়া ক্যানসার বহুরূপী। আর আক্রান্ত অঙ্গ থেকে ক্যানসার কোষের নিঃশব্দে রক্তবীজের মতো অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা রয়েছে। তাই আজও ক্যানসারের চিকিৎসা মানেই কঠিন লড়াই। সারা বিশ্বে অসুখে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ক্যানসারের স্থান দ্বিতীয়, হার্টের অসুখের পরেই।

১৯৪৭ সালে চিকিৎসক-বিজ্ঞানী সিডনি ফারবের লিউকোমিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিফোলেট ওষুধ ব্যবহার করে ফল পেয়েছিলেন। তার পর থেকে কেমোথেরাপির চিকিৎসা উন্নত হয়েছে অনেক। ১৮৯৫ সালে কনরাড রোনজেন-এর এক্স-রে আবিষ্কারের পরে চিকিৎসা হিসেবে রেডিওথেরাপি ব্যবহার এসেছে। সুস্থ কোষকে এড়িয়ে সূক্ষ্ম লক্ষ্যে আঘাত করে ক্যানসার কোষকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছে বিজ্ঞান। অত্যাধুনিক যন্ত্রের আবিষ্কারে ক্যানসারের শল্যচিকিৎসাও অনেক উন্নত হয়েছে। তবে এখনও ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দ্রুত রোগনির্ণয়, সতর্কতা, সচেতনতায় জোর দেওয়া হয়েছে। তাই যে কোন সন্দেহজনক উপসর্গ এড়িয়ে না যাওয়াই ভাল।

‘হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট’-এর গবেষণায় ২০০৩ সালেই জিনের জটিল ভূগোলের রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। এখন ‘ক্যানসার জিনোম এটলাস’-এর গবেষণায় ক্যানসারের জিন-শৃঙ্খল ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। ভোগেলস্টিন-এর মতো বিজ্ঞানী দেখছেন, ক্যানসার জিনের মিউটেশন ঘটে ১১টি থেকে ১৫টি পথ বা ‘পাথওয়ে’ ধরে। ক্যানসার যেন এক ‘পাথওয়ে ডিজ়িজ়’, কোষের ভুল পথে চলার অসুখ। ভবিষ্যতে হয়তো এই পথ রুদ্ধ করার ওষুধ আবিষ্কৃত হবে, যা আটকাতে পারবে ক্যানসারকে। অপেক্ষা সেই আগামী উজ্জ্বল দিনের।

ঋণ: দি এম্পায়ার অব অল ম্যালাডিজ়, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cancer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE