Advertisement
E-Paper

আজ জন্মদিনেই শুরু হোক রাকিব-স্মরণ

নানা বইয়ের মধ্যেই নিবিষ্ট থেকে মনের আরাম অনুভব করতেন এবং নিভৃতে কল্পনার নিখুঁত বুনটে নির্মাণ করতেন কবিতা ও গল্প— যার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে কলেজ পত্রিকার মাধ্যমে। স্বনামে ও ছদ্মনামে আব্দুর রাকিব লিখতে থাকেন একের পর এক কবিতা ও গল্প। লিখছেন অনির্বাণজ্যোতি সিংহ।মুরারই রেল স্টেশন থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরের প্রাচীন জনপদ এদরাকপুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে আব্দুর রাকিবের জন্ম। দিনটা ছিল ১৯৩৯ সালের ১৬ই মার্চ।

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯ ০২:০৪

মুরারই রেল স্টেশন থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরের প্রাচীন জনপদ এদরাকপুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে আব্দুর রাকিবের জন্ম। দিনটা ছিল ১৯৩৯ সালের ১৬ই মার্চ। বাবা আখতার হোসেন ও মা মরিয়ম নেসার স্নেহছায়ায় বেড়ে উঠতে থাকেন তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আব্দুর রাকিব। প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক বাবার সামান্য মাস মাইনের কারণে সংসারে ছিল অনটন। তা সত্ত্বেও ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল রাকিবের। নানা বইয়ের মধ্যেই নিবিষ্ট থেকে মনের আরাম অনুভব করতেন এবং নিভৃতে কল্পনার নিখুঁত বুনটে নির্মাণ করতেন কবিতা ও গল্প— যার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে কলেজ পত্রিকার মাধ্যমে। স্বনামে ও ছদ্মনামে লিখতে থাকেন একের পর এক কবিতা ও গল্প । এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘শরৎচন্দ্র’ কবিতা এবং ‘মংলু’ নামের ছোটগল্পের কথা উল্লেখ করা চলে। ছোটগল্পটি তিনি ছদ্মনামে লিখেছিলেন। তাঁর এই সৃষ্টি শিক্ষক ও ছাত্র মহলে প্রশংসার ঝড় তোলে। দ্বিগুণ উৎসাহে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠে পরের পর রচনা করতে থাকেন কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প , জীবন আলেখ্য, অনুবাদ সাহিত্য ও ধর্মীয় সাহিত্য ।

ব্যক্তিজীবনের ঘাত-প্রতিঘাত বিষয়ে অকপট না হলেও সাহিত্যিক রাকিব অকপট ভাষ্যে ও সুললিত শব্দবন্ধে অনবদ্য ভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সকল সৃষ্টি। তাঁর অন্তরে জমে থাকা কষ্টগুলোকে চেপে রেখেছিলেন আমৃত্যু। ২৯ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদের জিনদিঘির কবিয়াল গুমানী দেওয়ানকে নিয়ে লিখে ফেলেন ‘চারণ কবি গুমানী দেওয়ান’ নামের একটি জীবন আলেখ্য। এই গ্রন্থে এক দিকে গুমানী দেওয়ানের জীবন বৃত্তান্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই সঙ্গে তুলে ধরেছেন হাস্যরসে সিক্ত কবিগানের বিষয়বস্তুকে। দেশপ্রেম, দেশীয় ঐতিহ্য সব কিছুই সুচারুভাবে মেলে ধরেছেন আব্দুর রাকিব। প্রথমে হরফ প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়, পরে ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ তথ্য সংস্কৃতি দফতর বইটি প্রকাশ করে। এ-পার এবং ও-পার বাংলার পাঠক মহলে তাঁর এই সৃষ্টি ভূয়সী প্রশংসা কুড়োয়। এই বইটিই তাঁকে ‘কাফেলা সম্মান’ এনে দেয়।

মুর্শিদাবাদের বোখারা হাজি যুবেদ আলী বিদ্যাপীঠের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে পরিচিত থাকতেই আব্দুর রাকিব বেশি স্বছন্দ বোধ করতেন এবং সাহিত্যসেবী হিসাবে একদরাকপুরের ‘ছায়ানট’কেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। গ্রামের গরিব খেটে খাওয়া মানুষের প্রাত্যহিক যাপনের মধ্যেই খুঁজে পেতে চেয়েছেন তাঁর লেখনীর রসদ। তাই হয়তো শহরে গেলেও সেটা তাঁর কাছে ছিল মাঝে মাঝে ও-পাড়ায় যাওয়ার মতো। তাঁর এদরাকপুরের বাড়ি ‘ছায়ানট’ই ছিল যৌবনের বৃন্দাবন ও বার্ধক্যের বারাণসী। এখানেই তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘প্রতিকূলে একজন’, ‘বাদশাহ ও বাবুই বৃত্তান্ত’-এর মতো গল্প ; ‘সংগ্রামী নায়ক মওলানা আবুল কালাম আজাদ ‘, ‘একত্ববাদের মশাল দৌড়’, ‘আল কুরানের উপমা ব্যঞ্জনা’, ‘ইসলামে নারীর অবস্থান ও অধিকার’ প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থ। অনুবাদ সাহিত্যেও রাকিবের মুন্সিয়ানা তারিফযোগ্য। ‘ইসলাম প্রসারের ইতিহাস’, ‘কাশফুল মাহজুব’, ‘স্পেনের মুসলিম ইতিহাস তাঁর লেখা উল্লেখনীয় অনূদিত গ্রন্থ। আজীবন অসংখ্য সাহিত্য কৃতির মধ্যে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত ‘আব্দুর রাকিবের নির্বাচিত গল্প’, ‘বেড়ে ওঠার দিনগুলি’, ‘পথ পসারির পত্রোত্তর’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। লেখা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনও ছুৎমার্গ ছিল না। অসংখ্য ছোট পত্রিকাকে তিনি তাঁর লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।

রাকিবের লেখায় সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির কথা বারবার উঠে এসেছে। তিনি তাঁদের কথাই লিখেছেন, যাঁদের শিক্ষা নেই, বিত্ত নেই, নেই আভিজাত্য বা সংস্কৃতি। কিন্তু, দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য লড়াই করেও তাঁদের মধ্যে আছে একটা নৈতিকতা, মূল্যবোধ। এমনই সব প্রান্তিক জনের কথা বারবার ফুটে উঠেছে আব্দুর রাকিবের লেখার পরতে পরতে। এ সব কারণেই বোধহয় গ্রামীণ জীবন তিনি ত্যাগ করতে পারেননি। আর এ জন্যই হয়তো বড় কোনও সম্মাননা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।

একেবারে পাননি তা নয়। কিন্তু, তাঁর সাহিত্যকীর্তির যে স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল, তা পাননি। তবে আব্দুর রাকিব বেশ কিছু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে সংবর্ধিত হয়েছেন। আর পেয়েছেন তামাম মুরারই তথা বীরভূমের মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধা। আব্দুর রাকিবের মধ্যম পুত্র আবু মাসুদ (সন্দীপ) তাঁর সাহিত্যিক পিতার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমার বাবার দুটো দিক আমি লক্ষ্য করেছি। একটা স্কুলের শিক্ষকতা জীবন আর একটা সাহিত্য জীবন। অবশ্য স্কুলকে বাদ দিয়ে সাহিত্য কখনও করেননি। রবিবার বাবা বাড়িতে থাকতেন। বহু জায়গা থেকে লোক আসত লেখা দেখানোর জন্য। বাবা কাউকে নিরাশ করতেন না, বরং তাঁদের লেখার ভুল গুলো সংশোধন করে দিতেন।’’ মাসুদ জানালেন, তাঁর বাবা প্রতি মাসে একবার কলকাতা যেতেন বিভিন্ন সাহিত্য সভায় যোগ দিতে। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরে রাকিব সাহেব সাহিত্য চর্চাকেই প্রাধান্য দেন। বহু চিঠিপত্র আসত বাড়িতে। মাসুদের কথায়, ‘‘বাবার লেখার ধরণ, শব্দ চয়ন, ভাষাশৈলী ছিল ধারাল। ‘চারণ কবি গুমানি দেওয়ান’-এর পর থেকে বাবাকে সাহিত্যিকের জায়গায় পৌঁছতে বেগ পেতে হয়নি। মৃত্যুর আগে একটা শিরোনাম বিহীন গল্প লিখে গিয়েছেন। বাবা তাঁর সাহিত্য জীবনের যে সম্পদ রেখে গেলেন আমি তাঁর সন্তান হিসাবে সে কথা না বললেও পাঠক সমাজ যথাযথ মূল্যায়ন করবে আশা করি।’’

আব্দুর রাকিবের একান্ত ঘনিষ্ঠ ও ভক্ত এবং উত্তর বীরভূমের অন্যতম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ধ্বজাধারী দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের চেতনার ও পরিশীলিত ভাবনার সম্প্রসারিত রূপ আব্দুর রাকিব। নিষ্ঠাবান ও আদর্শময় শিক্ষকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আব্দুর রাকিব। উদার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সুস্থ সংস্কৃতি ও বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টির অনন্যতায় তিনি অনেকের চেয়ে আলাদা। আব্দুর রাকিব তাই আমাদের দৈনন্দিনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবেন যুগযুগ ধরে।’’ রামপুরহাট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অরিন্দম সিংহের মতে, ‘‘রাকিব সাহেব প্রকৃত অর্থেই ছিলেন সাহিত্য সাধক। সারস্বত সমাজের মধ্যে তাঁর গতায়াত ছিল অনায়াস। মহান সাহিত্যিকদের মতো তিনিও প্রতিদিন নিয়ম করে লেখার টেবিলে বসতেন ভোর বেলা। স্বাদু গদ্যে নির্ভার রচনা রসিক পাঠককে অনাবিল আনন্দ দিয়ে যাবে।’’ কলকাতার আলোকবৃত্ত থেকে দূরে থাকলেও তিনি স্বীয় গুণে দ্যুতিময় ছিলেন বলে মনে করেন অরিন্দমবাবু।

২০১৮-র ২১শে নভেম্বর আব্দুর রাকিবের অকস্মাৎ প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। বীরভূমের সাহিত্য জগৎ হয়ে পড়েছে অভিভাবকহীন। যদিও বীরভূমবাসীর মননে আব্দুর রাকিবের স্থান চিরস্থায়ী। ১৬ই মার্চ, তাঁর জন্মদিনটি তাঁর স্মৃতি তর্পণের নির্দিষ্ট দিন হিসাবে বেছে নিলে সেটাই হবে বীরভূম জেলার ‘সাহিত্য অভিভাবক’-এর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

(লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষক, মতামত নিজস্ব)

History Writer Abdur Raqib
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy