Advertisement
E-Paper

অসৌজন্যই নিয়ম

সৌজন্য নামক শব্দটি যে দ্রুততায় বিলুপ্তপ্রায় হইয়া গেল, তাহা বিস্ময়কর বটে। বঙ্গবাসী সেই বিস্ময়ের ঘোরেই অসৌজন্যের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদের নিকট জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আর অনুব্রত মণ্ডলই স্বাভাবিক। বিনয় কোঙারও। ফলে, ঘাটালের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দীপক অধিকারী যখন তাঁহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্টের সন্তোষ রানার বাড়িতে সত্যই সৌজন্যসাক্ষাতে উপস্থিত হইলেন, বঙ্গবাসীর চোখে ধাঁধা লাগিয়া গেল।

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০০:২৭

সৌজন্য নামক শব্দটি যে দ্রুততায় বিলুপ্তপ্রায় হইয়া গেল, তাহা বিস্ময়কর বটে। বঙ্গবাসী সেই বিস্ময়ের ঘোরেই অসৌজন্যের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদের নিকট জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আর অনুব্রত মণ্ডলই স্বাভাবিক। বিনয় কোঙারও। ফলে, ঘাটালের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দীপক অধিকারী যখন তাঁহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্টের সন্তোষ রানার বাড়িতে সত্যই সৌজন্যসাক্ষাতে উপস্থিত হইলেন, বঙ্গবাসীর চোখে ধাঁধা লাগিয়া গেল। ঘটনাটি সংবাদপত্রে শিরোনাম হইল, দলীয় কর্মীদের অসন্তোষের কারণও। যেখানে এই গোত্রের সৌজন্যসাক্ষাৎ নিতান্ত স্বাভাবিক এবং নিয়মিত ঘটনা হইবার কথা, সেখানে দীপকবাবু সন্তোষ রানার বাড়িতে চা পান করিতে গেলে তাহাকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রমের স্বীকৃতি দিয়া সুস্থ মনের বাঙালিকে এমন ধন্য-ধন্য করিতে হয় কেন? সকল কেন্দ্রের সকল প্রার্থী কেন এই সৌজন্য দেখাইতে পারেন না? এই প্রশ্নের উত্তরও বঙ্গজন জানেন। রাজনীতি আসিয়া এই সহজ সৌজন্যকে লইয়া গিয়াছে। এবং তাহার পিছনে বামপন্থীদের একটি ঐতিহাসিক দায় আছে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ যে রাজনৈতিক বিভাজিকায় আড়াআড়ি ভাবে ভাঙা এবং এক দিকের সহিত অন্য দিকের প্রায় জল-অচল সম্পর্ক, সেই দায়ের একটি বড় ভাগ বামপন্থীদের। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা উত্তরাধিকারী। দীপক অধিকারী ব্যতিক্রম। তাঁহাকে দেখিয়া অন্যরা পাল্টাইবেন? ভরসা কম।

ভারতের সব প্রান্তেই অসৌজন্যের চল বাড়িয়াছে। কটূক্তি হইতে হাত কাটিয়া লওয়ার হুমকি, সকলই চলিতেছে। কিন্তু, তাহার পাশাপাশি দুই বিরোধী দলের নেতা সহাস্য সৌজন্য বিনিময় করিতেছেন, এই ছবিও আছে। তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস প্রার্থী শশী তারুর তাঁহার প্রতিপক্ষ বিজেপি-র ও রাজাগোপালের সহিত তাঁহাদের কেন্দ্রের উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা করিতেছেন, এই দৃশ্যটি মাত্র এক সপ্তাহ পুরাতন। পশ্চিমবঙ্গে বৈর আছে, সহাবস্থান নাই। অথচ, এই রাজ্যই দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী— রাজনৈতিক ভাবে চূড়ান্ত অবস্থানের দুই নেতা— সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও জ্যোতি বসুর হৃদ্যতা দেখিয়াছে। এই রাজ্যেই বিরোধী নেত্রী তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর পদধূলি লইয়াছেন। গোটা ভারত যদি বৈরের পাশাপাশি সৌজন্যও বজায় রাখিতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ পারিল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বামপন্থীদের দিকেই নির্দেশ করিবে। যে বিরোধী নেত্রী বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর পদধূলি লইয়াছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তখন তাঁহার নাম উল্লেখের সৌজন্যও দেখাইতে পারেন নাই। তাঁহার দল প্রতিপক্ষের নেতার শারীরিক প্রতিবন্ধ লইয়া রসিকতা করিতেও ছাড়ে নাই। সেই মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরসূরি বিরোধী নেত্রীর সহিত কথা বলিতে বিবমিষার কথাও ফলাও করিয়া বলিয়াছিলেন। ক্ষমতার চাকা ঘুরিয়াছে। সৌজন্য ফিরে নাই।

অথচ, গণতন্ত্রের প্রাণভ্রমর এই সৌজন্য। রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ দুই দলের প্রতিনিধি পরস্পরের কথা শুনিবেন, গুরুত্ব দিয়া বিবেচনা করিবেন, নিজের কথা বুঝাইবার চেষ্টা করিবেন, সেই আলোচনা হইতেই উন্নয়নের পথ বাহির হইবে— ইহা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। সিপিআইএম-এর সমর্থকদের সামাজিক ভাবে বয়কটের ডাক দিলে কি আর আলোচনার অবকাশ থাকে? জল বামপন্থীরাই ঘোলা করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই পাঁক সরাইয়া স্বাভাবিকতায় ফিরিবার দায়িত্ব বর্তমান শাসকদের লইতে হইবে। দলের শীর্ষ নেত্রী যখন সৌজন্যের গুরুত্ব বোঝেন বলিয়াই বোধ হয়, তাঁহার দলকে সৌজন্যের পথে ফিরাইবার দায়িত্বও তাঁহারই। রাজনৈতিক বিরোধ সুতীব্র হউক, কিন্তু তাহা যেন ব্যক্তিকে ঢাকিয়া না ফেলে। অনিল বসু নহেন, আদর্শ মানিতে হইলে হীরেন মুখোপাধ্যায় স্মর্তব্য।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy