Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাত্কার

আমরা উন্নত, আদিবাসীরা অনুন্নত? কেন?

মূল ধারার শিল্পায়ন উন্নয়নের ফলে প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রার মান কমেছে। দারিদ্র বেড়েছে। তাঁরা জল, জঙ্গল, জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। বললেন চার্লস ডারউইনের প্রপৌত্র, নৃতত্ত্ববিদ ফেলিক্স প্যাডেল।

আন্তর্জাতিক। নিয়মগিরিতে বেদান্ত প্রকল্পের প্রতিবাদে। লন্ডন, ২০১০। গেটি ইমেজেস।

আন্তর্জাতিক। নিয়মগিরিতে বেদান্ত প্রকল্পের প্রতিবাদে। লন্ডন, ২০১০। গেটি ইমেজেস।

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

গত বছর ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেডের প্রকল্প আটকে গিয়েছে, শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছিল, আদিবাসী অধ্যুষিত ওই এলাকার ভূমিপুত্রদের অনুমোদন ছাড়া ওই প্রকল্প করা যাবে না। যে নিয়মগিরি পাহাড় খনন করে আকরিক অ্যালুমিনিয়াম বা বক্সাইট উত্তোলন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ওই ব্রিটিশ সংস্থাটির পক্ষ থেকে, তা লাঞ্জিগড়ের ডোঙ্গরি ও কোন্দ জনজাতির মানুষের দেবতা নিয়মরাজার স্থান। স্বভাবতই, ওই পাহাড় ভাঙা বা বিক্রি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা চূড়ান্ত প্রতিরোধ তৈরি করেন। তাঁদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের একাংশ। এর ফলেই প্রকল্পটি বাতিল হয়েছে, যা জয় হিসেবে দেখছেন আদিবাসী সমাজ ও বিভিন্ন পরিবেশকর্মী ও সংস্থা।

পূর্ব ভারতে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছেন নৃতত্ত্ববিদ ফেলিক্স প্যাডেল। সম্পর্কে তিনি চার্লস ডারউইনের প্রপৌত্র। ‘আউট অব দিস আর্থ’ নামে বইটিতে তিনি অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের ইতিহাস ও তার রাজনীতি নিয়ে যেমন কথা বলেছেন, তেমনই কথা বলেছেন ওড়িশার ওই আদিবাসীদের জীবন ও সাংস্কৃতিক স্বনির্ভরতা নিয়ে। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন ফেলিক্স। তখনই তাঁর সঙ্গে কথোপকথন।

নিয়মগিরিতে অ্যালুমিনিয়াম প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় ওড়িশার মতো গরিব রাজ্যের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হল না কি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অ্যালুমিনিয়ম শিল্পের বিকাশ। বিশেষ করে অস্ত্র শিল্প অ্যালুমিনিয়ম শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বক্সাইট হল আকরিক অ্যালুমিনিয়াম। তা মাটিকে সমৃদ্ধ করে। আজ অ্যালুমিনিয়ামের এত চাহিদা, কারণ তা অস্ত্র শিল্পের জন্য জরুরি। সেটা বিনিয়োগের একটা বিশাল ক্ষেত্র। কুড়ি বছরের চুক্তিতে এই প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে। অর্থাৎ কুড়ি বছরের মধ্যে যতটা সম্ভব আকরিক উত্তোলন করে চলে যাবে বিদেশি সংস্থা। তাদের লাভ হবে। তার ফল হিসেবে মাটি ও পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়। আগামী দু’হাজার বছরেও সেই ক্ষতি পূরণ করা যাবে না। পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ক্ষতি বয়ে নিয়ে চলতে হবে। ওড়িশার গরিব মানুষ ও আদিবাসীরা এই শিল্পের ব্যাপারে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। ওই রাজ্যের গরিব মানুষদের একাংশ, যাঁরা আদিবাসী নন বা সরাসরি এই শিল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন না তাঁরা হয়তো চেয়েছিলেন প্রকল্পটা হোক। ভেবেছিলেন, তাতে তাঁদের লাভ হবে। কিন্তু লাঞ্জিগড়ের আদিবাসী গ্রামগুলির মানুষ চাননি।

ওড়িশার আদিবাসীরা কি এত কিছু জানার পরে প্রতিবাদ করেছেন? না কি সেটা তাঁদের প্রাচীন মূল্যবোধের প্রতিফলন?

নিয়মগিরির আদিবাসীরা এত কিছু জেনে প্রতিরোধ করেননি ঠিকই। তাঁরা পাহাড়কে দেবতা বলে জানেন। ওড়িশার এক জন প্রথিতযশা লেখক গোপীনাথ মোহান্তি ১৯৪১ সালের জনগণনার নথিতে দেখেছেন, এক সরকারি আধিকারিক কোন্দ জনজাতির এক জনকে প্রশ্ন করছেন, তাঁর দেবতা কী। সেই ব্যক্তি তাঁকে উত্তর দিচ্ছেন, পাহাড়। গোপীনাথ জানাচ্ছেন, এই উত্তরটা সেই সরকারি আধিকারিকের কাছে খুব আশ্চর্যের। কারণ পাহাড় যে কখনও দেবতা হতে পারে, তা তিনি ভাবতে পারেন না। তাঁর ধারণাই নেই সেটা। অথচ আদিবাসীদের এই ধর্মের পিছনে একটা যুক্তি রয়েছে। তাঁরা জানেন, পাহাড় থেকে জল আসে। পাহাড় নষ্ট হয়ে গেলে জল আর পাওয়া যাবে না। জল ছাড়া জীবন চলবে কী ভাবে?

প্রশ্ন উঠেছে, গ্রামসভাগুলির সিদ্ধান্তের পিছনে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা কতখানি? আদিবাসীদের নিজেদের নির্ণায়ক ভূমিকা কতটা ছিল?

অনেকেই এই প্রশ্নটা করেছেন। কিন্তু আমি যতটুকু কাজ করেছি, তাতে বুঝতে পেরেছি গ্রামসভাগুলি চালাচ্ছিলেন এই আদিবাসীরাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক কর্মী ও অসরকারি সংস্থা এসেছে। কাজ করেছে। মনে রাখতে হবে, এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিও এই ব্যবস্থার অংশ। তাই তাদের ভূমিকার মধ্যেও স্ববিরোধিতা ছিল। কিন্তু সেই স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও তারা এই আন্দোলনের পাশে ছিল।


কী ভাবে?

এই আন্দোলন বা প্রতিবাদ প্রতিরোধ যাই বলো, দুটো স্তরে হয়েছে। গ্রামসভাগুলিতে দলিত ও ডোঙ্গরি জনজাতির নেতৃত্ব বেশি ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে বাইরের জগৎ, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে নানা জায়গায় বিষয়টাকে নিয়ে যাওয়া, এ-সবের অনেকটাই করেছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো। নিয়মগিরি একটা জটিল ক্ষেত্র, যেখানে প্রত্যেকের ভূমিকার মধ্যে এক ধরনের স্ববিরোধিতা রয়েছে, যা কোনও সহজ সমীকরণে ধরা যাবে না।


আপনি আদিবাসীদের নিজস্ব অর্থনীতির কথা বলছেন। সেটা কী?

প্রাচীন কাল থেকে আদিবাসীরা অরণ্য ও প্রকৃতিকে ব্যবহার করে, তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নিজেদের জীবন চালিয়ে আসছেন। তাঁরা প্রকৃতিকে ততটাই ব্যবহার করেন, যতটুকু প্রয়োজন। তাঁদের সমাজের যা প্রচল ও জীবনধারণের প্রক্রিয়া, তা অনেক উন্নত। আমরা কীসের ভিত্তিতে বলব, যে আমরা উন্নত, ওঁরা নন? আজ ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’-এর ধারণা উঠে আসছে, যার নামে ভারত, আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে চূড়ান্ত লুঠ চালানো হচ্ছে। প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। কিন্তু ওঁরা জানেন ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’-এর প্রকৃত অর্থ। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে জানেন ওঁরা। যদি গাছ কাটতে হয়, কখনও পাহাড়ের চূড়ার দিকে গাছ কাটেন না। পাশ থেকে কাটেন। যাতে পাহাড়ের ক্ষতি হয় না।


কিন্তু একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে। এই ভাবে নিজস্ব অর্থনীতিতে ফেলে রাখা কি কার্যত তাঁদের পশ্চাৎপদ করে রাখা নয়?

ডান-বাম নির্বিশেষে এই প্রশ্নটা করছেন। হেনরি জর্জের একটা বই রয়েছে, ‘প্রগ্রেস অ্যান্ড পভার্টি।’ দেড়শো বছর আগে লেখা সেই বইয়ে দেখা যাচ্ছে, এই রকম মূল ধারার শিল্পায়ন উন্নয়নের ফলে জীবনযাত্রার মান যতটা বেড়েছে, তার থেকে অনেক বেশি কমেছে। দারিদ্র বেড়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ যুক্তি দিচ্ছেন, আস্তে আস্তে নাকি উন্নয়নের সুফল চুঁইয়ে পড়বে এই প্রান্তিক মানুষদের কাছে। কিন্তু বাস্তবত তা হয়নি। উপরন্তু তাঁরা জল, জঙ্গল, জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। নিয়মগিরির আদিবাসী গ্রামসভাগুলি পেরেছে এই ধরনের উন্নয়নকে আটকে দিতে।


ভারতের খনি আইন ৪৯ শতাংশ বিদেশি লগ্নির অনুমতি দিয়েছে। এখন খনিই হল সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। নিয়মগিরি কি ব্যতিক্রম নয়?

নিয়মগিরি ব্যতিক্রম। নিয়মগিরিতে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। সরকার বাধ্য হয়েছিল। মধ্য ভারত, ওড়িশায় যে ভাবে খনি তৈরি হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের আরও ভাল করে বোঝা দরকার আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান ও তাদের স্বার্থগুলো। আজ যদি বেদান্ত সংস্থা বলে কালাহান্ডির অন্য প্রান্তে প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে যাব, সেটাও বিপজ্জনক।


নিয়মগিরি সফল, ওড়িশায় পস্কো ইস্পাত প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন সফল নয় কেন?

পস্কোতে স্টিল প্ল্যান্ট হচ্ছে না। সেখানে লোহার আকরিক উত্তোলনের জন্য খনি হবে, যা চিন ও অন্যান্য এশীয় দেশগুলিতে রফতানি করা হবে। তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে কলিঙ্গনগরের পরিবেশ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি পস্কো আটকাতে পারেননি, নিজেই সে কথা স্বীকার করেছিলেন। তাঁর এই স্বীকারোক্তির তো একটা তাৎপর্য রয়েছে।


আপনি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক স্বনির্ভরতার কথা বলছেন। আধুনিক শিক্ষার ব্যাপারে আপনার কী মতামত?

আধুনিক শিক্ষা দেওয়ার নাম করে যা চলছে, আমার কাছে তা এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক রেসিজম’, যা অন্য সংস্কৃতি, অন্য জ্ঞান কাঠামোকে বাতিল করে, যা বলে: তুমি শুধু শেখাবে, তোমার শেখার কিছু নেই। এটা ঔপনিবেশিক আমল থেকে হয়ে আসছে। আসলে ভারতের আদিবাসীরা কখনও নিজেদের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। সেখান থেকে তাঁরা শিখেছেন, তাঁরা প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার নামে যা চলছে তা প্রতিযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। যে প্রতিযোগিতা এই মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থারই একটা অংশ। এটা আদিবাসীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিজস্বতাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খুব কম সংস্থাই বিকল্প শিক্ষা নিয়ে ভাবছেন। তাঁরা তাঁদের মতো ছোট ছোট করে চেষ্টা করছেন।


আপনি বলছেন, যেটাকে আমরা অনুন্নত বলে মনে করে এসেছি, সেটা আসলে অনেক অনেক বেশি উন্নত একটা ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে আপনি চার্লস ডারউইনের ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ প্রসঙ্গে কী বলবেন?

আমি আমার কাজকে ডারউইনের কাজের সঙ্গে যুক্ত বলেই মনে করি। ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ শব্দবন্ধটা তাঁর নয়, হার্বার্ট স্পেনসারের। ডারউইন দেখেছিলেন কী ভাবে বিভিন্ন প্রাণী ও প্রজাতি পরস্পর ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, খাপ খাইয়ে নিজেদের বিকশিত করছে। এই কথাটি ব্যবহার করে সামাজিক উত্তরণের যে একরৈখিক বয়ান অনেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তা ঠিক নয়। আমাদের দেখা উচিত, কী ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, সখ্য গড়ে তুলে বিভিন্ন জনজাতি বিকশিত হয়। আমি মনে করি, উন্নয়নের একরৈখিক বয়ানে সেই বিকাশকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

সাক্ষাৎকার: রূপসা রায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

felix padel rupsa roy interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE