Advertisement
E-Paper

ঐশ্বর্য ও শ্রী

স্বামীটি নেশাখোর, অসংসারী। উপার্জনের ঠিকঠিকানা নাই। কিন্তু প্রবল খাদ্যরসিক। চার পুত্র-কন্যার সংসারে গৃহিণীকেই তাই দশহাতে কাজ সামলাইতে হয়, ঘরে ও বাহিরে। এই দশভুজার রূপগুণে মধ্যযুগের বাংলাকাব্য পরিপূর্ণ। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কিংবা রামেশ্বরের শিবায়ন গুণবতীর কথায় পঞ্চমুখ। অভাবের সংসার গুছাইয়া চালাইতে যথেষ্ট পারদর্শিতা প্রয়োজন। সকলের দ্বারা তাহা সম্ভব নহে। বঙ্গসমাজে প্রাচুর্য ও শ্রী সুপরিচিত শব্দ। শব্দ দুইটি সমার্থক নহে। প্রাচুর্য থাকিলেই যে শ্রী থাকিবে, এমন ভাবিবার কারণ নাই।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

স্বামীটি নেশাখোর, অসংসারী। উপার্জনের ঠিকঠিকানা নাই। কিন্তু প্রবল খাদ্যরসিক। চার পুত্র-কন্যার সংসারে গৃহিণীকেই তাই দশহাতে কাজ সামলাইতে হয়, ঘরে ও বাহিরে। এই দশভুজার রূপগুণে মধ্যযুগের বাংলাকাব্য পরিপূর্ণ। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কিংবা রামেশ্বরের শিবায়ন গুণবতীর কথায় পঞ্চমুখ। অভাবের সংসার গুছাইয়া চালাইতে যথেষ্ট পারদর্শিতা প্রয়োজন। সকলের দ্বারা তাহা সম্ভব নহে। বঙ্গসমাজে প্রাচুর্য ও শ্রী সুপরিচিত শব্দ। শব্দ দুইটি সমার্থক নহে। প্রাচুর্য থাকিলেই যে শ্রী থাকিবে, এমন ভাবিবার কারণ নাই। কোনও গৃহ নানা মূল্যবান উপাদানে পরিপূর্ণ। সেই দেখনদারি সুন্দর না-ই লাগিতে পারে। বরং ধনের গর্ব ও ঔদ্ধত্য দেখিয়া দমবন্ধ হইয়া আসা সম্ভব। দুর্গার সংসারে প্রাচুর্য নাই, বরং অভাব, তবে শ্রীটি ষোলো আনা। কোনও দিন হয়তো শিব সামান্য কিছু ভিক্ষা লইয়া আসিলেন। সেই সামান্য উপকরণে দেবী এমন সরস ব্যঞ্জন রন্ধন করিলেন যে পুত্রকন্যা আর পিতার তৃপ্তির শেষ নাই। এই গৃহিণীপনা বঙ্গদেশের মহিলারা জানিতেন। কৃপণতা নহে, স্বল্পব্যয়ে শ্রীময়তা বজায় রাখা। ইহা এক দিক হইতে বড় কঠিন অর্থনৈতিক কৃত্য। শরত্‌চন্দ্র একাধিক উপন্যাসে সাধারণ বাঙালি মেয়েদের এই অসাধারণ গুণটির কীর্তন করিয়াছেন। না করিয়া উপায় নাই।

গৃহের অভ্যন্তরে শ্রীমন্ত হইয়া ঘরদুয়ার সামলাইবার ধারাটি সামাজিক দিক দিয়া তাত্‌পর্যবাহী। রবীন্দ্রনাথ ইহাকেই কুবের ও লক্ষ্মী, দুই বিপরীতের তুলনায় বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন। পল্লি সংগঠন ও গ্রামসমাজ নির্মাণের প্রকল্পকে তিনি শ্রীনিকেতনের অন্তর্গত করিয়াছিলেন। তাঁহার বক্তব্য ছিল, ধনের অসমঞ্জস, বৃহত্‌ সাধনা অনেক সময় কুবেরের ন্যায় অমঙ্গলের সাধনা হইয়া উঠে। সেই ধনসম্পদ সামাজিক ভাবে কাজে লাগে না। এই অসামঞ্জস্য বড় দুস্তর ও ক্ষতিকর। অনেক সময় আধুনিক নগরগুলি এই ভাবে পল্লিসমাজকে রিক্ত করিতেছে। ভূসম্পদের বিত্তহরণের ফলে গ্রাম শ্রীহীন হইয়া পড়িতেছে। আমাদের ধর্মের মধ্যে যে তৃপ্তিদায়ক সামাজিকতাটুকু ছিল, তাহাকে স্বীকার করিবার জন্য প্রচলিত অর্থে ধার্মিক হইবার প্রয়োজন নাই।

বঙ্গদেশে এক্ষণে যে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাহা নিতান্ত ধর্মীয় উত্‌সব নহে। সেখানে সামাজিকতাটি মুখ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইহা হিন্দুদের উত্‌সব, অ-হিন্দুদেরও। আলো ঝলমল, আনন্দ মুখরিত গ্রাম-নগরী। নিত্য একঘেয়ে জীবনযাত্রার মাঝে ইহা ভাল লাগিবার কথা। তবে এই আনন্দযাপনও বহুলাংশে পুনরাবৃত্ত, ক্লান্তিকর। একদা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় উনিশ শতকীয় বারোয়ারি ও বাবুবাড়ির দুর্গাপূজাকে তীব্র সমালোচনা করা হইয়াছিল। ইহা কেবল হিন্দু-ব্রাহ্মের দ্বন্দ্ব ছিল না। দৃষ্টিভঙ্গি ও নান্দনিক বোধের দ্বন্দ্বও ছিল। অনামা লেখক মনে করাইয়া দিয়াছিলেন, দুর্গাপূজার নামে বড় অপচয় হইয়া থাকে। অর্থের, সময়ের। এ যুগেও বিবিধ ক্লাব বা সঙ্ঘের পূজায় অপব্যয় ও অপচয়ের শেষ নাই। অপচয়ের টাকা প্রয়োজনে নানা দিক হইতে আসে। উদ্দেশ্য ক্লাবকে খুশি রাখিয়া পাড়াকে রাজনৈতিক ভাবে বশীভূত করা। এই অপচয় অ-নান্দনিক ও অনিষ্টকর। পুরাণে, মঙ্গলকাব্যে যে দেবী শ্রীময়ী, অপচয়ের নান্দনিকতার বিরুদ্ধে যাঁর ঘর-সংসার, তাঁহাকে ঘিরিয়া এই অপচয়ের প্রদর্শনী প্রশ্ন তোলে বইকী। সে প্রশ্ন লইয়া নাগরিককেই ভাবিতে হইবে। ইহা নিছক অর্থ অপচয়ের প্রশ্ন নহে, নাগরিকতার অপচয়ও ইহাতে নিহিত আছে।

editorial anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy