Advertisement
E-Paper

কৌতুকের নামে

গোঁড়ামির সঙ্গে থাকব না, অবশ্যই। কিন্তু পিতৃতন্ত্র মেয়েদের সম্বন্ধে যে কুরুচিকর ভাষায় কথা বলে, তার প্রতিবাদ জানাব না কেন?কথাটা পোপ ফ্রান্সিস মনে করিয়েছিলেন। ক’দিন আগে আবার মনে করালেন বারাক ওবামা। গোটা ইউরোপ যখন জো সুই শার্লি আবেগে ভাসছে, ঠিক তখনই। ওঁরা দুজনেই এ কথা বলা প্রয়োজন মনে করলেন— সন্ত্রাসের প্রতিবাদ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সব ঠিক আছে। কিন্তু লাগাতার অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে কথা বলে যাওয়াটাও উচিত কাজ নয়।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

কথাটা পোপ ফ্রান্সিস মনে করিয়েছিলেন। ক’দিন আগে আবার মনে করালেন বারাক ওবামা। গোটা ইউরোপ যখন জো সুই শার্লি আবেগে ভাসছে, ঠিক তখনই। ওঁরা দুজনেই এ কথা বলা প্রয়োজন মনে করলেন— সন্ত্রাসের প্রতিবাদ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সব ঠিক আছে। কিন্তু লাগাতার অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে কথা বলে যাওয়াটাও উচিত কাজ নয়।

কোনও নতুন কথা নয় এটা। স্বাধীনতা ব্যাপারটা যে যা খুশি তাই করার অধিকার নয়, তা কে না জানে? তবু দেখাই যাচ্ছে, জানা কথাও মনে করিয়ে দেওয়া মাঝে মাঝেই বড় আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

শার্লি এব্দো একটি ব্যঙ্গচিত্রের পত্রিকা। ব্যঙ্গচিত্র ছাপার দায়ে জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ দিতে হবে, এমন ঘটনা কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। পোপ ফ্রান্সিস বা ওবামা, দুজনের কেউই জেহাদি মৌলবাদের সমর্থক বলেও পরিচিত নন। তবু তাঁরা কথাগুলি বললেন।

এই মুহূর্তে বলিউডে এআইবি রোস্ট শো আর যৌন রসিকতা নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ভেবে দেখা যেতে পারে, সেখানেও এই কথাগুলো মনে রাখার দরকার ছিল কি না। আমির খান অনেকটা এই ধাঁচেই সওয়াল করেছেন ইতিমধ্যে। তাঁর মন্তব্যের এন্তার সমালোচনাও হয়েছে। আপাতত অশালীনতার দায়ে রোস্ট শো-এর সঙ্গে জড়িত বলিউডের ১৪ জনের নামে আদালতের নির্দেশে এফআইআর হয়েছে।

শার্লি এব্দোর ঘটনার সঙ্গে রোস্ট শো-এর তুলনা? খুবই বালখিল্যসুলভ শোনাল হয়তো। কিন্তু মত প্রকাশের অধিকার বা রসিকতার অধিকারের প্রশ্নগুলো তো দুটি ক্ষেত্রেই রয়েছে। অথচ রোস্ট শো স্বাধীনতার সীমা ছাড়িয়েছে কি না, এ প্রশ্ন তোলাটা ঠিক যেন ফ্যাশনেবল নয়। রঙ্গরসিকতার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, শ্রেণিবিদ্বেষের ছোঁয়া থাকলে স্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রশ্নটা খুব সহজে ওঠে। মান্যতাও পায়। পাওয়াই উচিত। কিন্তু রসিকতার আড়ালে লিঙ্গবিদ্বেষের কথা উঠলে এখনও যেন সাত খুন মাফ।

এর পিছনে দুটো কারণ আছে। একটা পরিস্থিতিগত কারণ, আর একটা ভাবনাগত কারণ।

পরিস্থিতিগত কারণটা বোঝা কঠিন নয়। বিষয়টা হচ্ছে এই যে, রোস্ট শো নিয়ে যাঁরা ইতিমধ্যেই শোরগোল পাকিয়েছেন, নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাতে স্বচ্ছন্দ নন। কারণ অশালীনতার প্রশ্নে যাঁরা সচরাচর সরব হন, তাঁরা কেউ কেউ একটি বিশেষ রাজনৈতিক শিবিরের কাছের লোক বলে পরিচিত। রাম এবং গরুড়ও তাই। কেউ কেউ, আমরা জানি, আজ রোস্ট শো নিয়ে ভুরু কঁুচকোচ্ছেন, কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে বন্ধ করতে বলবেন। পার্কে প্রেমিকপ্রেমিকাকে কান ধরে ওঠ-বস করাবেন। ধর্ষণ ঠেকাতে মেয়েদের রাতে রাস্তায় বেরোতে নিষেধ করবেন। সিনেমায় যৌনদৃশ্য রুখে দেবেন। এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সেন্সরশিপের পক্ষপাতী নই বলে আমরা তাঁদের প্রতিবাদেও শামিল নই। অশালীন-সনাতন ঐতিহ্যবিরোধী-পশ্চিমী কুপ্রভাব— এই মাপকাঠিগুলো নিয়েই আমাদের ঘোর অরুচি। কারণ এই সব ক’টা শব্দের গায়ে পিতৃতন্ত্রের ঝাঁঝাঁলো গন্ধ লেগে আছে।

কিন্তু গোঁড়ামির সঙ্গে থাকব না বলে স্বেচ্ছাচারকে মেনে নেব, এ কেমন কথা? পিতৃতন্ত্র যে ভাষায় প্রতিবাদ করে, নাগরিক সমাজের কাজ ছিল, সেই ভাষাটি পরিহার করা। অশালীনতা-কুরুচি নয়, সামাজিক প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল লিঙ্গচেতনার প্রশ্নে। পুরুষত্বের আস্ফালনের প্রশ্নে। যৌন ভাষা, যৌন আচরণের মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরনো নারীবিদ্বেষ আর অবমানবায়নের প্রশ্নে। তোমার রসিকতা মানে আমার অবমাননা— এই ‘সনাতন’ সমীকরণ মানছি না, মানব না বলার প্রশ্নে। সেই প্রতিবাদ কতটুকু হল? বলিউডের ভিতরে যাঁরা এ কথাগুলো বলতে পারতেন, তাঁরা অনেকেই কিন্তু বললেন না সে ভাবে। পাছে আগমার্কা গোঁড়াদের সঙ্গে কেউ তাঁদের গুলিয়ে ফেলে! পাছে সেন্সরপন্থী বলে বদনাম কুড়োতে হয়! এর বিরুদ্ধে কথা বললেই ওর লোক হয়ে যেতে হবে— এই দ্বন্দ্বসমাস এখনও ঘুচল না। সেন্সর চাই না, নারীজাতির ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত বলে মনে করি না, কিন্তু সেক্সিজমের প্রতিবাদ করছি— এত নিক্তি মেপে কথা বলছেই বা কে? শুনছেই বা কে? থাক গে, কাজ নেই তবে! এই হচ্ছে আমাদের একটা বড় অংশের নাগরিক মনোভাব।

মেয়েদের তো আরও বেশি। নিজেদের নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর মস্করা শুনেও নিজেরাই হাসছি! আমাদেরও রসবোধ আছে, তার প্রমাণ দিতে হবে না? ‘সবেতেই বাড়াবাড়ি’ জাতীয় টিপ্পনী থেকে বাঁচতে হবে না? প্রতিবাদ না হওয়ার পরিস্থিতিগত কারণ আর ভাবনাগত কারণ এইখানে এসে মিলেমিশে যায়।

অনেকে বলবেন, এত শত ভাবলে বাপু আমোদ করাই চলে না! ওইটুকু লাইসেন্স ছাড়া চলবে কী করে? বেশ যুক্তি! আজ যদি শ্বেতাঙ্গরা বলেন যে, যুগ যুগ ধরে কালোদের নিয়ে যে সব ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে এসেছি, সেগুলো চালিয়ে যেতে চাই! সেটা সমর্থনযোগ্য হবে তো? ‘হাস্যকৌতুক’-এর সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে করুন! যেখানে বলা হচ্ছে, কৌতুক মাত্রেই ‘‘...ঈষত্‌ পীড়াজনক; কিন্তু সেই পীড়ার পরিমাণ এমন নিয়মিত যে, তাহাতে আমাদিগকে যে পরিমাণে দুঃখ দেয়, আমাদের চেতনাকে অকস্মাত্‌ চঞ্চল করিয়া তুলিয়া তদপেক্ষা অধিক সুখী করে। এই সীমা ঈষত্‌ অতিক্রম করিলেই কৌতুক প্রকৃত পীড়ায় পরিণত হইয়া উঠে।’’

এক কালে গোরা সাহেবরা আমাদের ব্যঙ্গ করেছে, সেই ক্ষত কিন্তু আজও পুরো মিলিয়ে যায়নি। জাত-ধম্মো নিয়ে ব্যঙ্গ করাটা সুশীল সমাজ অন্তত এখন অসভ্যতা বলে মনে করে। তার কিছুটা অবশ্যই ভাবনার পরিবর্তনের কারণে, আর অনেকটা দায়ে পড়ে। কারণ সমাজের অনেক সমীকরণ বদলে গিয়েছে। ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হবে, এই আশঙ্কা এবং বাস্তবতা দুইই তৈরি হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা এখনও হয়নি। বেফাঁস কথা কইলে হাঙ্গামা বেধে যাবে, মেয়েদের নিয়ে এমন ভয় চট করে কেউ পায় না। অতএব সকল রসের ধারা তোমাতেই হল হারা! এআইবি একটি ধর্মসম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে, কিন্তু মেয়েদের হেয় করা হল কি না সে প্রশ্নে এখনও নীরব।

এমনই তো হয়ে থাকে। নিতান্ত নিরীহ ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যে খুনের মোটিফ খঁুজে পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অধ্যাপককে জেলে পাঠিয়ে সংগত কারণেই নিন্দার্হ হয়েছিলেন। অথচ সেই মুখ্যমন্ত্রীরই নারীসত্তাকে নানা ভাবে অসম্মান করে কত ব্যঙ্গচিত্রই তো ছড়িয়েছে! সেন্সর নয়, প্রতিবাদ প্রয়োজন ছিল বইকী! সদ্য প্রয়াত আর কে লক্ষ্মণের আঁকা কার্টুন বাঁধিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন নেহরু, এই কাহিনি সকলের মুখে মুখে ফেরে! নেহরুর গুণগ্রাহী মনের কদর এতটুকু কমে যাবে না, যদি স্মরণে রাখি, লক্ষ্মণ সেই দরের শিল্পী যিনি তীক্ষ্ন ব্যঙ্গ জানতেন। চটুল টিটকিরি নয়।

post editorial jagori bandopadhay jagori banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy