Advertisement
২৩ মে ২০২৪
সম্পাদকীয়

ক্ষমার ক্ষমতা

ইরানে প্রকাশ্য শহর-চত্বরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার প্রচলন আছে। গত মঙ্গলবার এক যুবককে ফাঁসি দিবার আয়োজন হইয়াছিল, প্রচুর মানুষ ভিড় করিয়া তাহা দেখিতে আসিয়াছিলেন। এই যুবক, যাহার নাম বিলাল, সাত বৎসর পূর্বে (তখন তাহার বয়স ১৭) সমবয়সি বন্ধু আবদল্লাকে একটি বাজারের মধ্যে মারামারি করিয়া, ছুরিকাঘাতে খুন করে। আবদল্লার মা ও বাবা এই ফাঁসি দেখিতে আসিয়াছিলেন। ইরানের নিয়ম অনুযায়ী, যদি হত মানুষের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করিয়া দেয়, তাহা হইলে মৃত্যুদণ্ড মকুব হয়।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ২৩:৫৯
Share: Save:

ইরানে প্রকাশ্য শহর-চত্বরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার প্রচলন আছে। গত মঙ্গলবার এক যুবককে ফাঁসি দিবার আয়োজন হইয়াছিল, প্রচুর মানুষ ভিড় করিয়া তাহা দেখিতে আসিয়াছিলেন। এই যুবক, যাহার নাম বিলাল, সাত বৎসর পূর্বে (তখন তাহার বয়স ১৭) সমবয়সি বন্ধু আবদল্লাকে একটি বাজারের মধ্যে মারামারি করিয়া, ছুরিকাঘাতে খুন করে। আবদল্লার মা ও বাবা এই ফাঁসি দেখিতে আসিয়াছিলেন। ইরানের নিয়ম অনুযায়ী, যদি হত মানুষের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করিয়া দেয়, তাহা হইলে মৃত্যুদণ্ড মকুব হয়। যখন বিলালের চক্ষু বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাকে একটি চেয়ারে চড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে, ফাঁসির দড়িটিও গলায় পরাইয়া দেওয়া হইয়াছে, সেই শেষ মুহূর্তে আবদল্লার মা সমবেত জনতার সম্মুখে একটি বক্তৃতা দেন, তাহার পর বিলালকে একটি সপাট চড় মারেন, তাহার পর তাহাকে ক্ষমা করিয়া দেন। বিলালের মা-বাবা আবদল্লার মা-বাবাকে পদচুম্বন করিয়া, জড়াইয়া ধরিয়া কৃতজ্ঞতা জানান। জনগণ সহর্ষ হাততালি দিয়া তাঁহাদের অভিনন্দিত করে। বিলাল যাহাতে ক্ষমা পায়, তাহার জন্য কিছু সংগঠন ও খ্যাত ব্যক্তি বেশ কিছু দিন ধরিয়া আর্জি জানাইতেছিলেন, কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা তাহা মানিয়া লইলেও, আবদল্লার মা রাজি হন নাই। হত্যাকারীর ক্ষমাভিক্ষা ও আর্তনাদ শুনিয়া হউক, একটি মানুষের হত্যামঞ্চ স্পষ্ট প্রস্তুত দেখিয়া ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ অনুভব করিয়াই হউক, মা ক্ষমা করিলেন। নাটকীয়তায় অনেকেই আলোড়িত হইয়াছেন। ছবি দেখিয়া মনে হইতেছে, হত্যা দেখিতে আসিয়া ক্ষমা দেখিয়া বাড়ি ফিরিতে কাহারও তেমন আপত্তি নাই। সকলেই মানবিকতার জয়ে হরষিত ও কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত।

ক্ষমা এক আশ্চর্য। যে আমার ক্ষতি করিল, আমি তাহার ক্ষতি কামনা করিলাম না, নশ্বর মস্তিষ্কে এই সিদ্ধান্তের আবির্ভাব খুব সহজ নহে। গাঁধী বলিয়াছিলেন, ক্ষমা দুুর্বলের পক্ষে অসম্ভব, প্রকৃত ক্ষমতাবানই ক্ষমা করিতে পারেন। প্রায় সকল পণ্ডিত ক্ষমার উচ্ছ্বসিত গুণগান গাহিলেও, মানুষ কিন্তু ক্ষমা দেখিলে সাধারণত চটিয়া যায়। যুধিষ্ঠির সদা-ক্ষমাশীল ও হিংসাবিমুখ ছিলেন বলিয়া অধিকাংশ মানুষ তাঁহাকে কাপুরুষ ও নিরুদ্যমী ভাবিয়া তিরস্কার করে। ভারত-পাকিস্তান খেলা হইলেই বুঝা যায়, হিংসা দ্বেষ ঘৃণা কী প্রবল জনপ্রিয়। সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপনে ক্ষমা অতি বিরল। পথে প্রতি পদে পদে কলহ চলিতেছে, চালকের সহিত যাত্রীর, যাত্রীর সহিত সহযাত্রীর, হকারের সহিত ক্রেতার, পথচারীর সহিত সাইকেল-আরোহীর। যাঁহারা কলহ করিতেছেন না, তাঁহারা ভীরু বা নির্বিরোধী বলিয়া ঝঞ্ঝাট এড়াইয়া সরিয়া আসিতেছেন, কিন্তু ক্ষমা করিতেছেন না। মনে মনে তাঁহারা শত্রুকে নিরন্তর এমন মোক্ষম কথা শুনাইতেছেন, তাহার বিষে তাঁহার অন্তর পরবর্তী দুই ঘণ্টা ধূমাচ্ছন্ন থাকিতেছে। অফিসে, বাজারে, আত্মীয়সভায়, এমনকী শয্যায়, কেবল অক্ষমার বেসাতি। আর তত্ত্বগত ভাবে যতই ক্ষমার পক্ষে সওয়াল হউক, প্রিয়জনের হত্যাকারীকে ক্ষমা কি সম্ভব? একবালপুরে দুই বালিকাকে হাতুড়ি মারিয়া যাহারা হত্যা করিল, দিল্লিতে যাহারা গণধর্ষণ করিল, সেই বালিকা বা যুবতীর আত্মীয়েরা অপরাধীদের কাছে টানিয়া চুম্বন করিতে পারিবেন? ইহা বাস্তবে ঘটে? তাহা হইলে আবদল্লার মাতা ক্ষমা করিলেন কেন? যে রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে ফাঁসি হয় এবং মানুষ ফুটবল ম্যাচের ন্যায় তাহা দেখিতে আসেন, সেখানে ক্ষমা না করিলেও তাঁহাকে কেহ কিছু বলিত না। না কি, সেই জন্যই সমষ্টির সম্মুখে ক্ষমার লোভ প্রবল হইয়া উঠিল? হিংসা যেখানে সোৎসাহে অনুমোদিত, সেখানে ক্ষমাই তাঁহাকে ব্যতিক্রমী করিবে, সমীহ দিবে? না কি তিনি নিজেকে অতিক্রম করিয়া সত্যই এই মহত্ত্বে উপনীত হইলেন: এই প্রাণহরণ তাঁহার সন্তানের প্রাণহরণের ক্ষতি লাঘব করিবে না? শেষ নাটকীয় চড়টি তিনি কাহাকে মারিলেন? বিলালকে, না, নিজ ক্ষমা করিতে নারাজ সত্তাটিকে?

য ৎ কি ঞ্চি ৎ

গার্সিয়া মার্কেস মারা গেলেন, বাঙালি রণেবনেক্যান্টিনে জাদুবাস্তবতার দিকে টাল খেল। আসলে বাংলা তো লাতিন আমেরিকাই, জাদু ২৪x৭, গরমকালে যাকে আরও তপ্ত থাকতে হবে তার ঘরে এসি মেশিন আপনিই ফেটে যাচ্ছে। একের পর এক বন্ধ খাম আবির্ভূত হচ্ছে আদালত জুড়ে, গোপন নাম প্রকাশিত হলে ধুন্ধুমার। গনগনে প্রতিভা নেই বলে কেউ এ কাণ্ডকে নোবেল-নভেলে মুড়তে পারেনি, তা বলে জাদুবাস্তব-‘ওবিচুয়ারি’ লিখতে এ ভূমিতে সবাই কোমর বাঁধবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE