Advertisement
০৪ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ক্ষমতার হাতটাকে ‘না’ বলা জরুরি

ভয় করে, যখন দেখি, যিনি ঘরে বাইরে লড়াই করে উঠে এসেছেন, তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, কোর্ট, মানবাধিকার কমিশন, মিডিয়া, পুলিশ প্রশাসন, সব কিছুকে নিজের প্রয়োজন মতো ছাঁচে ঢেলে নিতে চাইছেন। কৌশিক সেনবানভট্টের ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থের ‘সপ্তম উচ্ছ্বাস’-এর প্রথম দিকে রয়েছে ‘গৌড়বঙ্গ’র বিরুদ্ধে ‘দণ্ডযাত্রার বর্ণনা’: ‘রাজার বিপুল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে, কত শব্দ চারিদিকে, কত পশু, কত মানুষ, কর্মব্যস্ত নানান ধরনের কর্মীরা, মাহুত, সহিস, অশ্বরক্ষক, ভাণ্ডাররক্ষী, চেটক, স্থানপাল’... ডিএম, এসপি, অবজারভার, মাইক্রোঅবজারভার, পুলিশ অবজারভার, রাজ্য পুলিশ, সেন্ট্রাল ফোর্স...

এবং মুখ্যমন্ত্রী। (ডান দিক থেকে) রুদ্রনীল ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

এবং মুখ্যমন্ত্রী। (ডান দিক থেকে) রুদ্রনীল ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

উৎসবপ্রধান দেশ, আমরা গণনায় মাতি।

সকালে আবির বেশী বিক্রি হয়।

রাতে মোমবাতি।

—শ্রীজাত

বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থের ‘সপ্তম উচ্ছ্বাস’-এর প্রথম দিকে রয়েছে ‘গৌড়বঙ্গ’র বিরুদ্ধে ‘দণ্ডযাত্রার বর্ণনা’: ‘রাজার বিপুল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে, কত শব্দ চারিদিকে, কত পশু, কত মানুষ, কর্মব্যস্ত নানান ধরনের কর্মীরা, মাহুত, সহিস, অশ্বরক্ষক, ভাণ্ডাররক্ষী, চেটক, স্থানপাল’... ডিএম, এসপি, অবজারভার, মাইক্রোঅবজারভার, পুলিশ অবজারভার, রাজ্য পুলিশ, সেন্ট্রাল ফোর্স...

বাণভট্ট লিখছেন: ‘ধুলোয় ধরণী আচ্ছন্ন... হাতির পায়ের তলায় কত মাটির কুটির পিষ্ট হয়ে গেল। রাজন্যরা আসছেন গজবধূদের পিঠে চড়ে বহু রত্নমাণিক্যে ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে’... হেলিকপ্টার নামছে ধুলোয় উড়িয়ে, লাল সবুজ গেরুয়া পতাকা, নেতানেত্রীদের মুখোশে ঢাকা মানুষের মুখ, মোটরসাইকেলবাহিনী, তারকাখচিত শোভাযাত্রা, স্লোগান...

এই সব পার হয়ে যখন এক জন ভারতবাসী ভোট দিতে যান এবং যাওয়ার পর শোনেন যে তাঁর ভোটটা পড়ে গেছে, তখন তাঁর কেমন লাগে? পশ্চিমবঙ্গে যখন সম্প্রতি এমন ঘটল, তখন নানান আশঙ্কা প্রতিবাদের মাঝেও খেয়াল করেছি কেমন নীরবে ছড়িয়ে পড়েছে একটা যুক্তি: ‘আরে, নতুন কিছু হচ্ছে নাকি?’

সত্যি তো, সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট তো এই ভাবেই ভোট করাত, তৃণমূলও তা-ই করছে, নতুনটা কী? ছাগশিশু বলি হতে দেখে বালিকা অপর্ণার কান্না, যা দেখে পরদিন রাজসভায় রাজা গোবিন্দমাণিক্যের ঘোষণা: ‘বালিকার মূর্তি ধরে স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন রাজরক্ত সহে না তাঁর...’ পাল্টা যুক্তি দেন ত্রিপুরেশ্বরীর পূজারি রঘুপতি: ‘এতদিন সহিল কী করে? সহস্র বৎসর ধরে রক্ত করেছেন পান আজি এ অরুচি?’

রঘুপতির যুক্তি ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। রাজনীতি মানেই শক্তির আস্ফালন, ভোট মানেই সবলের জয়, দুর্বলের স্থান নেই। লাল জমানায় যা যা অন্যায় ঘটেছে, সবুজে পৌঁছে ভিন্ন কিছু চাইবার কী আছে? ‘এতদিন সহিল কী করে?’

ভোট আসুক না আসুক, আজ বসন্ত! গোটা বছর জুড়ে শাসকেরা এই বার্তাই দেন। ২০০৭-এর জুন মাসে অশোক মিত্র মহাশয় যে চিঠি লিখেছিলেন তাঁর কমরেডদের উদ্দেশে, তাতে খুব স্পষ্ট ছিল যে বার্তাটি, তা হল, ‘এই মুহূর্তে পশ্চিম বাংলায় যা প্রধান বিতর্ক, তা উন্নয়ন-তপস্বী ও স্থবিরতা-প্রেমিকদের কোঁদলঘটিত নয়, কৃষি বনাম শিল্প এই ধরনের কাল্পনিক, আছড়াআছড়ি নিয়েও নয়। সমস্যাটি আদর্শানুগত্য বনাম আদর্শবিস্মৃতির।’ (এত দিন ডাকে না-ফেলা চিঠি)

এই আদর্শবিস্মৃতির বা নীতিহীনতার কাদাজল আজ আরও বেশি ঘোলাটে। তাই তো আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কত সহজে বলে দিতে পারেন, ‘আমরা বেঁচে গেলাম, সি বি আই-এর বাবা তদন্ত করলেও আপত্তি নেই। আমার আর দায়িত্ব থাকল না। আই অ্যাম টোটালি সেফ।’

১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১, আমরা যে তিন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছি বা দেখছি, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কোনও মিল নেই। কোনও তুলনামূলক আলোচনাই এখানে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই তিন মহারথী যে যাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস-স্বপ্নকে অবহেলা করেছেন। জ্যোতি বসুর কিংবদন্তি চাহনিতে, বাচনভঙ্গিতে থাকত এক অদ্ভুত শীতলতা ও কাঠিন্য, যা এক সময় আচ্ছন্ন করেছিল আমাদের। আমরা মুগ্ধ হতাম ওই প্রবল ব্যক্তিত্ব দেখে, দূর থেকে চলত পুজো করা আর তারই ফাঁকে কখন যেন বদলে গেল সব। বদলাতে লাগল একটু একটু করে। আমার মনে আছে, ১৯৮৯ লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুরে দীর্ঘকাল বাদে জয়ী হলেন বামপন্থীরা। মালিনী ভট্টাচার্য পরাজিত করেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাত বারোটার পর গোটা ভবানীপুর জুড়ে বামপন্থীদের বিজয় মিছিল বেরিয়েছে। আমরা, কমবয়সি কর্মীরা জড়ো হয়েছি পটুয়াপাড়ায়, কালীঘাট লোকাল কমিটির অফিসের সামনে। হঠাৎই অতি-উৎসাহী কিছু কমরেড একটা ট্যাক্সি ধরে, লাল পতাকা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এলাকায় ঘুরতে শুরু করল। আধ ঘণ্টা বাদে যখন তারা এসে পার্টি অফিসের সামনে নামল, গোটা পরিবেশটা থমথমে। এক জন প্রবীণ কমরেড, বড়সড় কেউ নয়, খুব শান্ত ভাবে এসে ছেলেগুলিকে বললেন, ‘তোমরা বাড়ি চলে যাও, আজ এই বিজয় মিছিলে যোগদান করার যোগ্যতা নেই তোমাদের; আর হ্যাঁ, ট্যাক্সিভাড়াটা দিয়ে দাও, আমাদের অনুমতি নিয়ে তো কাজটা করোনি।’ শত অনুরোধ, কান্নাকাটিতেও গলানো যায়নি ভদ্রলোককে। বিজয় মিছিল মানে অসভ্যতা নয়, ভোটে জেতা মানে ফুটবল ম্যাচ জেতা নয় ওই তরুণ কমরেডরা শিক্ষা পেয়েছিল সে দিন। শিক্ষা দিয়েছিলেন যিনি, তাঁরা ক্রমে বিরল প্রজাতির মানুষে পরিণত। ঘটনাটা চোখের সামনে আজও স্পষ্ট। তাই বোধ হয় আশা ছিল নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-এর পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুরা ওই রকমই শান্ত গলায় লক্ষ্মণ শেঠ, অনিল বসু, তপন-সুকুর, সুশান্ত ঘোষ, মজিদ মাস্টারদের বলবেন, ‘এ বার যাও। এ পার্টিতে থাকার যোগ্যতা তোমাদের নেই।’ এমনটা ঘটেনি।

হয়তো আজ তাঁরা বুঝছেন দলের প্রকৃত সম্পদ কারা। বর্তমান শাসক দলের হুমকি-আক্রমণ সহ্য করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অতি সাধারণ কর্মীরা, না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে আগ্রহী বাবুশ্রী লক্ষ্মণ শেঠ, একদা যাঁর আয়োজিত ‘হলদিয়া উৎসব’-এ যোগ দিতে ঢল নামত মানুষের, শিল্পীদের। ক্ষমতা যখন মধ্যগগনে থাকে, তখন কি চোখ ধাঁধিয়ে যায় আমাদের? আমরা চারপাশটা দেখতে পাই না? আমরা, যারা নিজেদের ‘সৃষ্টিশীল’ মনে করি, আমরাও কি শাসকদের মতো করেই দেখতে চাই সবটা? সমস্ত নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে আমরাও কি এটাই বিশ্বাস করি যে ‘ভোট’ ও তার ‘ফলাফল’ই শেষ কথা বলে?

ভোটে জয় মানেই সব ‘অন্যায়’ মান্যতা পেয়ে গেল? নরেন্দ্র মোদীর অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে যে বিপজ্জনক গরম বক্তৃতা, তার বিরুদ্ধে সরব হয়ে পথে নেমেছেন গুণিজনেরা। কিন্তু ‘সারদা’ বা ‘টেট পরীক্ষা’ নিয়ে যে কেলেঙ্কারি এবং সে সব কিছুকে ধামা চাপা দিতে জ্যোতি বসুর মতো তাচ্ছিল্য বা উপেক্ষা নয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নীরবতা নয়, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর নেতাদের প্রধান অস্ত্র অসহিষ্ণু আক্রমণ ও চিৎকার এ মনোভাব যে অচিরেই পশ্চিম বাংলাকে নিয়ে যাবে আরও অস্থিরতার মধ্যে, আরও সমস্যার মধ্যে, সে কথা কি বুঝতে পারছেন না আমাদের এই রাজ্যের গুণিজনেরা?

শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা বহু সময়, বহু মানুষকে বিব্রত করে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় এটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আমার ভয় করে তখনই, যখন দেখি গণ-আন্দোলনের এই সাহসী নেত্রী, যিনি ঘরে বাইরে নানান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠে এসেছেন, তিনি এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, পরিকাঠামোকে নিজেই চ্যালেঞ্জ করছেন। কোর্ট, মানবাধিকার কমিশন, মিডিয়া, পুলিশ প্রশাসন, সমস্ত কিছুকেই নিজের প্রয়োজন মতো ছাঁচে ঢেলে নিতে চাইছেন। ভয় করে, যখন অনুব্রত মণ্ডল, মুন্নারা ঘুরে বেড়ায় অবাধে। ভয় করে আরাবুল ইসলামদের। আরও ভয় করে, যখন দেখি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এঁদের প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন। যাঁরা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ‘অরাজনৈতিক’ ঘনিষ্ঠজন, যাঁরা একদা ‘বাবা-কাকা’র ঐতিহ্য বাঁচাতে বাম প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন, অথবা ভোট দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে পাড়ার ‘কাকু’ তাঁর ভোটটা দিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা আজ মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দিদি’ বলে ডাকতে পারার আবেগে মথিত, তাঁদেরই তো আরও বেশি করে সরব হয়ে বলা প্রয়োজন যে, এ বারে লোকসভা নির্বাচনের একাধিক দফার ভোটে প্রচুর কারচুপি হয়েছে। ‘নতুন কাকু’রা নবরূপে আবির্ভূত। শিক্ষিত নাগরিক সমাজ আর কী করতে পারে সমস্বরে ‘না’ বলতে পারে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই ‘না’-এর জোর কতটুকুই বা? আসলে ক্ষমতার বাড়িয়ে ধরা হাতটা ঝাঁকুনি দিয়ে সরিয়ে ‘না’ বলাটা এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন। যিনি বা যাঁরা ‘না’ বলছেন, তাঁদেরও উপকার হবে, ‘যিনি’ বা ‘যাঁরা’ ‘না’ শুনছেন, তাঁদেরও উপকার হবে।

বাণভট্টের ‘দণ্ডযাত্রা’র বিবরণে পড়েছি, রাজার সৈন্যদের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে কৃষকের খেতের পাকা শস্য। সেই শোকে তারা প্রাণভয় বিসর্জন দিয়ে সপরিবার ছুটে এসেছে এবং চিৎকার করে বলছে, ‘এই দণ্ডযাত্রা শেষ হলে বাঁচি, অতিলোভের অবসান হোক। এ কেমন রাজা?’

সারদাকাণ্ড ক্রমশ প্রকাশ্যে আনছে তাঁদের, যাঁরা চোরকে মদত দিয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, সেটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার, কিন্তু গরিব মানুষ সুবিচার পাক, বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের জন্য শাস্তি পাক অপরাধীরা, প্রতিষ্ঠা হোক ন্যায়। নয়তো গরিব মানুষের ভয় ও ধৈর্য একটা সময় ঘুচে যাবে এবং সেটা বর্তমান শাসক দলের কাছে মোটেও সুখকর হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho koushik sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE