Advertisement
E-Paper

জনসংখ্যার ভূত

অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস আবারও লজ্জিত হইতেন। অমোঘ অনিবার্য জনবিস্ফোরণের যে তত্ত্ব তিনি বড় মুখ করিয়া প্রচার করিয়াছিলেন এবং তাঁহার ভক্তরা দুই শতাব্দী যাবত্‌ যে তত্ত্বের ধুয়া ধরিয়া জনসংখ্যার চাপে পৃথিবীর ভাঙিয়া পড়িবার ভবিষ্যদ্বাণী শুনাইয়া আসিতেছেন, তাহার শেষ ভরসা ছিল ভারত। বিপুল হইতে বিপুলতর জনসংখ্যাই এই দেশের প্রকৃত সমস্যা, জনবিস্ফোরণ দমন করিতে না পারিলে সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী— এমন ধারণা এ দেশে এখনও বহুলপ্রচলিত।

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস আবারও লজ্জিত হইতেন। অমোঘ অনিবার্য জনবিস্ফোরণের যে তত্ত্ব তিনি বড় মুখ করিয়া প্রচার করিয়াছিলেন এবং তাঁহার ভক্তরা দুই শতাব্দী যাবত্‌ যে তত্ত্বের ধুয়া ধরিয়া জনসংখ্যার চাপে পৃথিবীর ভাঙিয়া পড়িবার ভবিষ্যদ্বাণী শুনাইয়া আসিতেছেন, তাহার শেষ ভরসা ছিল ভারত। বিপুল হইতে বিপুলতর জনসংখ্যাই এই দেশের প্রকৃত সমস্যা, জনবিস্ফোরণ দমন করিতে না পারিলে সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী— এমন ধারণা এ দেশে এখনও বহুলপ্রচলিত। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ঠিকই বলিয়াছিলেন, মৃত ধারণারাই দীর্ঘকাল রাজত্ব করে। মৃত ধারণার প্রভাবে সঞ্জয় গাঁধী তাঁহার গুণমুগ্ধ জননীর প্রশ্রয়ে ভারতের দারিদ্র দূর করিবার তাগিদে বলপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্রতী হইয়াছিলেন। ভারতীয় গণতন্ত্র সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে, কিন্তু আজও দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়: কাজটা তো জরুরি ছিল, জোর না করিলে জন্মনিয়ন্ত্রণ হইবে কী উপায়ে?

দীর্ঘশ্বাস পড়িতে থাকুক, সত্য ইহাই যে, ভারত জন্মনিয়ন্ত্রণের পথে দিব্য অগ্রসর হইতেছে, তাহার জন্য জরুরি অবস্থা জারি করিতে হয় নাই, চিনের ন্যায় ‘এক সন্তান নীতি’র রক্তচক্ষু প্রদর্শনেরও প্রয়োজন হয় নাই, অন্তত সরাসরি কোনও জোর-জবরদস্তি ছাড়াই জন্মের হার কমিতেছে। সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য জানাইতেছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের গতি পূর্বপ্রত্যাশার তুলনায় দ্রুততর। ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসআরএস)-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় এক জন গড়পড়তা ভারতীয় নারীর সন্তানসংখ্যা ছিল ৩.৬, ২০১৩ সালে তাহা কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ২.৩। এই সংখ্যা ২.১-এ পৌঁছাইলে বলা যাইবে, ভারতের জনসংখ্যা স্থিতিশীল হইবার পর্ব শুরু হইয়াছে। নূতন তথ্য বলিতেছে, ২০২২ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা সর্বাধিক উচ্চতায় পৌঁছাইবে, তাহার পর শুরু হইবে কমিবার পালা। সঞ্জয় গাঁধী চমত্‌কৃত হইতেন।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে অবশ্য ভারতের এই অভিজ্ঞতা কেবল প্রত্যাশিত নহে, স্বাভাবিক বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার প্রসার বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি হার কমাইতে খুব বড় ভূমিকা লইয়াছে। বস্তুত, চিনকে বাদ দিলে বলপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণের কাহিনি ভূভারতে বিশেষ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। ভারতে পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার প্রসার আদৌ সন্তোষজনক হয় নাই, এখনও অনেক দূর যাইতে হইবে, বিশেষত, উত্তর ও পূর্ব ভারতে। এই পশ্চাত্‌পদ অঞ্চলগুলিতেই জন্ম-হার এখনও দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতের তুলনায় বেশি। কিন্তু সীমিত অগ্রগতি সত্ত্বেও জন্মহার কমাইবার ক্ষেত্রে সাফল্য এবং অগ্রগতির মাত্রার সহিত সেই সাফল্যের অঞ্চল-ভিত্তিক যোগাযোগ, দুই দিক হইতেই বোঝা যায়, যথার্থ সর্বজনীন উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হইতে পারিলেই জনবিস্ফোরণের বিপদও দূর হইবে। জনসংখ্যার বেলাগাম বৃদ্ধি অমোঘ নহে, অনিবার্যও নহে। বিপুল জনসংখ্যা লইয়া সমস্যা অবশ্যই আছে। কিন্তু তাহা সংখ্যার সমস্যা নহে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাইবার সমস্যা। দুই-তৃতীয়ংশ ভারতবাসীর বয়স পঁয়ত্রিশের নীচে। শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান, দক্ষ সত্তর-আশি কোটি নাগরিক পৃথিবী জয় করিতে পারে। কিন্তু তাঁহাদের অধিকাংশ অপুষ্ট, অশিক্ষিত, অদক্ষ হইলে পরিণাম কী হইতে পারে, ম্যালথাসও ভাবিয়া আতঙ্কিত হইতেন।

editorial anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy