Advertisement
E-Paper

তেত্রিশ কোটি মোরা

কবির বচন যত পুরানো হয়, তত মূল্যবান। প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এক বাঙালি কবি লিখিয়াছিলেন, ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’, সেই কথা আজও দিব্য বলা চলে। কেবল বলা চলে না, বলা জরুরিও। গৌরব দিয়া লজ্জা ঢাকিবার জন্য জরুরি। লজ্জা দীনতার। ভারতীয় কবি যখন স্বদেশবাসীকে ধরমেতে ধীর এবং করমেতে বীর হইবার আহ্বান জানাইয়াছিলেন, তখন দীনতার ধারণাটি মানুষ তাহার স্বাভাবিক বোধ হইতেই বুঝিয়া লইত, তত দিনে দাদাভাই নওরোজির ‘পভার্টি অ্যান্ড দি আনব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ রচিত এবং প্রসিদ্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু অঙ্ক কষিয়া দারিদ্রের অনুপাত স্থির করিবার বিদ্যা তখনও অনাগত।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫

কবির বচন যত পুরানো হয়, তত মূল্যবান। প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এক বাঙালি কবি লিখিয়াছিলেন, ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’, সেই কথা আজও দিব্য বলা চলে। কেবল বলা চলে না, বলা জরুরিও। গৌরব দিয়া লজ্জা ঢাকিবার জন্য জরুরি। লজ্জা দীনতার। ভারতীয় কবি যখন স্বদেশবাসীকে ধরমেতে ধীর এবং করমেতে বীর হইবার আহ্বান জানাইয়াছিলেন, তখন দীনতার ধারণাটি মানুষ তাহার স্বাভাবিক বোধ হইতেই বুঝিয়া লইত, তত দিনে দাদাভাই নওরোজির ‘পভার্টি অ্যান্ড দি আনব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ রচিত এবং প্রসিদ্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু অঙ্ক কষিয়া দারিদ্রের অনুপাত স্থির করিবার বিদ্যা তখনও অনাগত। আজ দারিদ্র বলিলেই পণ্ডিতরা দারিদ্র সীমা নির্ধারণ করেন এবং কত শতাংশ মানুষ সেই সীমার নীচে, তাহা মাপিতে বসেন। নানা পণ্ডিতের নানা মত, সেই সকল মতামত লইয়া তুমুল এবং অনন্ত তর্ক চলিতে থাকে, অতি-উৎসাহীরা সরকারি দারিদ্র সীমার নীচে কিছুকাল জীবন যাপনের ব্রত লইয়া প্রমাণ করিতে চাহেন যে ওই সীমা অন্যায়, অবাস্তব, অপমানজনক। দরিদ্র ভারতবাসী এই নাট্যরঙ্গ দেখিবার সময় পান না, কারণ তাঁহাকে দিন আনিয়া দিন খাইতে হয়। কিন্তু এই নিরবচ্ছিন্ন শোরগোলের শেষে জাগিয়া থাকে শাশ্বত সত্য: আমরা দীন হইতে পারি, কিন্তু হীন নহি। হীনতার মাত্রা স্থির করিতে এখনও কোনও অঙ্ক কষা হয় নাই, পণ্ডিতরা এখনও কোনও ‘হীনতা রেখা’ আবিষ্কার করেন নাই, সুতরাং ‘নহি মোরা হীন’ বলিতে ভারতবাসীর কোনও অসুবিধা নাই, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর আসনে যখন একজন প্রকৃত বলশালী পুরুষ। কিন্তু যে পণ্ডিত যে দারিদ্র রেখা দিয়াই মাপ কষিতে বসুন, ভারতের দারিদ্র হিমালয়প্রতিম জাগিয়া থাকে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর এক নূতন পরিসংখ্যানেও সেই সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। ২০১১ সালের হিসাবে, দুনিয়ার ১০১ কোটি দরিদ্রের মধ্যে ৩০ শতাংশের বাস ভারতে। লোকসংখ্যা বেশি, তাই দরিদ্রের সংখ্যাও বেশি, এই যুক্তি যত দূর যায় তত দূর সঙ্গত, কিন্তু অধিক দূর যায় না, তাহার কারণ চিনের জনসংখ্যা ভারত অপেক্ষা (এখনও) অনেকটা বেশি, কিন্তু বিশ্বের দরিদ্রসভায় তাহার ভাগ মাত্র ৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্ক-আইএমএফ-এর হিসাবে, কাহারও দৈনিক ব্যয় সওয়া এক ডলারের কম হইলে তাঁহাকে দরিদ্র বলিয়া গণ্য করা হয়। এই দারিদ্র সীমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে যে, ইহা অত্যন্ত কম। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর জবাবটি চমৎকার: এত নিচু দারিদ্র সীমা নিশ্চয়ই মর্মান্তিক, কিন্তু আরও অনেক বেশি মর্মান্তিক হইল এই সত্য যে, দুনিয়ার সাত ভাগের এক ভাগ মানুষ তাহারও নীচে।’ ভারতের ক্ষেত্রে অনুপাতটি তিন ভাগের এক ভাগ, মর্মান্তিকতার মাত্রাও সমানুপাতিক। তাহার অর্থ এই নয় যে, দারিদ্র কমে নাই। এই সমীক্ষাই জানাইতেছে, কমিয়াছে, কমিতেছে। কিন্তু তাহা কতটা দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি, কতটুকু ইউপিএ জমানার দ্বিতীয় পর্বে প্রদত্ত রকমারি ভর্তুকির সাময়িক ফলমাত্র, তাহা স্পষ্ট নহে। স্পষ্ট ইহাই যে, অর্থনীতির যথার্থ সর্বজনীন উন্নয়ন ভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র মোচন সম্ভব নহে। তেমন উন্নয়ন না হইলে বাজেট ঘাটতির তাড়নায় এবং পরামর্শদাতাদের প্রেরণায় মোদী সরকার খাদ্য ও কর্মসংস্থান ভর্তুকি ছাঁটাই করিবে এবং ভারতীয় দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িবে, এমন আশঙ্কা প্রবল। তখন দরিদ্র ভারতবাসী সত্যই গাহিবেন: তেত্রিশ কোটি মোরা...

anandabazar editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy