Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পাঁচিল ভাঙবেই

আজ ঠিক পঁচিশ বছর হল। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯, শুরু হয়েছিল বার্লিনের প্রাচীর ভাঙার ইতিহাস। প্রমাণ হয়েছিল, ক্ষমতা শেষ কথা বলে না।পুরো তিন দশকও টেকেনি পাঁচিলটা। ৯ নভেম্বর মধ্যরাত থেকেই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছিল ‘চেকপয়েন্ট চার্লি’তে, আরও নানা জায়গায়। সে দিন বিকেলেই পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান গুন্টার শাবস্কি ঘোষণা করেছেন, পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে যেতে আর বাধা থাকবে না। তার পরই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছে ৪৩ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিলের সামনে। মেশিনগান হাতে প্রহরীদের কাছে তখনও সরকারি নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পুরো তিন দশকও টেকেনি পাঁচিলটা। ৯ নভেম্বর মধ্যরাত থেকেই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছিল ‘চেকপয়েন্ট চার্লি’তে, আরও নানা জায়গায়। সে দিন বিকেলেই পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান গুন্টার শাবস্কি ঘোষণা করেছেন, পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে যেতে আর বাধা থাকবে না। তার পরই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছে ৪৩ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিলের সামনে। মেশিনগান হাতে প্রহরীদের কাছে তখনও সরকারি নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি। ও পারে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই প্রহরীদের বুলেটবৃষ্টিতেই এত দিন দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত।

রাত প্রায় দশটা। ভিড় ক্রমশ ফেঁপে উঠছে। অজস্র মানুষের হাতে ব্যানার: ‘দ্য পিপল লিড... পার্টি লিম্পস বাহাইন্ড।’ পশ্চিম বার্লিনে উত্তাল ভিড়, নিয়ন আলোর নীচে শ্যাম্পেন আর বিয়ারের ফেনিল স্ফূর্তি। হর্ন বাজাচ্ছে অজস্র গাড়ি: ‘আবার আমরা এক’। বিশৃঙ্খল হইচইয়ের মাঝে খুলে দেওয়া হল চেকপয়েন্ট। ভেঙে গেল ২৮ বছরের পুরনো প্রাচীর। রাত ১০টা ৪৫। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯। দুনিয়ায় এর আগে বহু বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটেছে। কিন্তু এ ভাবে বিপ্লব আর উৎসব কখনও একাকার হয়নি। আজ সিরিয়া, মিশরে যে রক্তহীন আরব বসন্তের অভ্যুত্থান, তার পথপ্রদর্শক ছিল ২৫ বছর আগে বার্লিন প্রাচীরের অবলুপ্তি।

সিকি শতাব্দীতে রাইন বেয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। অঙ্ক বলবে, ৯ নভেম্বর মোটেও পাঁচিলটা পুরো ভাঙা যায়নি। লোকে পাঁচিলের গায়ে গাঁইতি, শাবল চালাচ্ছিল, ইটের টুকরো সাবেক কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির স্মারক হিসেবে নিলামে বিক্রি হচ্ছিল। পরের বছর ১৩ জুন থেকে সরকারি ভাবে দেওয়াল ভাঙা শুরু হয়, দুই জার্মানির মুদ্রাব্যবস্থা এক হতেও সময় লেগেছিল। কিন্তু শুরুটাই তো মাহেন্দ্রক্ষণ! তখনও রোমানিয়ায় চাওসেস্কু নামে এক অত্যাচারী শাসক। দু’মাস আগেই চিনের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ট্যাঙ্ক ঢুকে বিদ্রোহী ছাত্রদের গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তার পরই পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট নেতা এরিক হোনেকার জানিয়েছেন, ‘পাঁচিল দরকার হলে ৫০ বছর, একশো বছর থাকবে।’ ক্ষমতা শেষ কথা বলে না।

দুনিয়া বলত, বার্লিন ওয়াল। পূর্ব জার্মানি আদুরে নাম দিয়েছিল: অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট প্রোটেকশন র্যাম্পার্ট। পশ্চিম জার্মানির ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত থেকে পূর্ব জার্মানির মানুষকে বাঁচানোর র্যাম্পার্ট! মহাযুদ্ধের পরই অবশ্য এই র্যাম্পার্ট তৈরি হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ী বীরেরা নিজেদের মধ্যে জার্মানিকে পিঠে-ভাগ করে নেয়। সোভিয়েত প্রাধান্যের অংশটিতে প্রথমেই ঢুকল স্তালিনের গুপ্তচরবাহিনি। প্রশাসনে, সামরিক ব্যবস্থায় তখন মস্কোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ১৯৪৯ সালে তৈরি হল নতুন কমিউনিস্ট দেশ: জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক।

নতুন দেশ তৈরির পর পূর্ব জার্মানির লোক দলে দলে পশ্চিমে পাড়ি দিতে শুরু করল। রুটি, মাংস, দুধ কিছুই ঠিকঠাক জোটে না। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান: নতুন দেশ তৈরির পর ১৯৫০ সালে দেশ ছাড়লেন পূর্ব জার্মানির ১ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষ। তিন বছর পরে ১৯৫৩ সালে সংখ্যাটা দাঁড়াল ৩ লক্ষ ৩১ হাজার। আর এক ‘এক্সোডাস’, শুধু কোনও মোজেস ছিলেন না। দলে দলে পাড়ি দিচ্ছিলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশেষজ্ঞ... প্রাইভেট সিটিজেন। বেশির ভাগই ২০ থেকে ৪০।

১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর তৈরির পিছনে কোনও সাম্যবাদী প্রেরণা ছিল না। পূর্ব জার্মানিতে কমে যাচ্ছে দলে দলে তরুণ পেশাদার। স্তালিন বিদেশমন্ত্রী মলোটভকে নোট দিলেন, ‘অসহনীয় পরিস্থিতি। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির সীমারেখাটি এ বার থেকে সীমান্ত হিসেবে দেখতে হবে। বিপজ্জনক সীমান্ত!’ দুই জার্মানির বিভাজনের কথা উঠলেই অনেক বাঙালির চোখে অশ্রু ঝরে, ইংরেজরা আমাদের পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গকেও এ ভাবে কাঁটাতারের বেড়ায় ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিচয়পত্র নিয়ে দুই বাংলার মধ্যে সে দিনও যাতায়াতের বাধা ছিল না, আজও নেই। চিনারাও দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে পাঁচিল তুলেছিল। বার্লিন প্রাচীর ব্যতিক্রমী। তার মূল মন্ত্র: যেতে নাহি দিব।

মন্ত্রটি পালন করা হল দ্রুত। ১৯৬১ সালের ১৩ অগস্ট, রবিবার ভোরে পূর্ব জার্মানির সেনাবাহিনি ও কমিউনিস্ট পার্টি পজিশন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। প্রথমে কাঁটাতার, তার পর ১২ ফুট উঁচু কংক্রিটের ব্লক। জায়গায় জায়গায় ১১৬টি ওয়াচ টাওয়ার, ২০টি বাঙ্কার। দেশ ছাড়ার আর প্রশ্ন নেই। ২৮ বছরে পাঁচিল পেরোনোর চেষ্টা করেছিল মাত্র ৫ হাজার মানুষ।

ঠান্ডা যুদ্ধের দুনিয়ায় বার্লিন প্রাচীর তখন একটা প্রতীক। পশ্চিমে গণতন্ত্র, শান্তি। পূর্বে দারিদ্র ও একনায়কত্ব। পাঁচিল তৈরির পরই পশ্চিম বার্লিনে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, “আমি নিজেকে বার্লিনের নাগরিক মনে করি। এই দুনিয়ায় মুক্ত মানুষ মানেই বার্লিনের লোক।” পাঁচিল ভেঙে যাওয়ার দু’বছর আগে ব্রান্ডেনবুর্গ গেটে রোনাল্ড রেগনের বিখ্যাত বক্তৃতা: ‘মিস্টার গর্বাচভ, এই গেট খুলে দিন। ভেঙে ফেলুন পাঁচিল।’ রাজনৈতিক নেতারা সে দিন বক্তৃতার নৌকো ভাসিয়েছেন পশ্চিম বার্লিনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে। অথচ পাঁচিল ভেঙে পড়ার এক বছর আগে পূর্ব বার্লিনে কনসার্ট করতে এলেন ব্রুস স্প্রিংস্টিন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ঘোষণা: ‘আমি কারও পক্ষে নই, বিপক্ষেও নই। আজ রক এন রোল গাইতে এসেছি একটাই আশায়। দুনিয়ার সব পাঁচিল এক দিন ভেঙে যাবে।’ সে দিন বোঝা গিয়েছিল, প্রকৃত শিল্পীরা কোথায় এগিয়ে। তাঁরা রাজনৈতিক গণ্ডি ছেড়ে পাঁচিল ভাঙার ডাক দেন।

ভাঙা পাঁচিলের গায়ে নিরুচ্চার লেখাগুলিও কি কম মূল্যবান? পৃথিবী যখন পাঁচিল ভাঙার আনন্দে উত্তাল, জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাসের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল অন্য সুর: দুই জার্মানি এক হয়েছে, ভাল। জার্মান জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ঘটলে কিন্তু আমার ভয় লাগবে। নব্যনাৎসিদের বাড়বাড়ন্তের সময় ২৫ বছর আগের সেই চেতাবনি কে ভুলবে! মনে পড়ে, বার্লিন প্রাচীর নিয়েই ছিল ষাটের দশকে জন ল্য কার-এর প্রথম বিখ্যাত উপন্যাস: দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড। উপন্যাসের শুরুতেই একটি গুপ্তচর-চরিত্র পশ্চিম পারে আসতে গিয়ে প্রহরীর গুলিতে মারা যায়। পূর্ব জার্মানির সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে ব্রিটিশ গুপ্তচর জর্জ স্মাইলি ও আলেক লেমাসের টক্কর চলতে থাকে। লেমাস বলে, “এটা একটা যুদ্ধ। খুব ছোট মাপে, ক্লোজ রেঞ্জে। মাঝে মাঝে নিরীহরাও মারা যাচ্ছে, খারাপ লাগে। কিন্তু গত যুদ্ধ বা ভবিষ্যতে যে যুদ্ধ ঘটবে, তার থেকে মৃত্যুর সংখ্যা কম।” ল্য কারের উপন্যাস প্রথম দেখাল, পাঁচিল কিছু আটকাতে পারে না।

পাঁচিল সমাজতান্ত্রিক হোক বা ধনতান্ত্রিক, সমান ভয়ানক। দুই কোরিয়ার মাঝখানে অক্ষরেখা ৩৮ কিংবা গাজা স্ট্রিপের সীমান্ত— দুনিয়ার যেখানে পাঁচিল থাকবে, রাষ্ট্রের মদতে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে। বার্লিন প্রাচীরের অবসান তাই নিছক সিকি শতাব্দী আগের ইতিহাস নয়। সামনে তাকানোর দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

goutam chakraborty editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE