গৌ রী সেন ও রামা কৈবর্তকে এক হারে কর দিতে হইলে দ্বিতীয় জনের প্রতি তাহা ঘোর অবিচার। অর্থনীতির পড়ুয়ারা বলিবেন, সেই কারণেই পরোক্ষ করকে ‘রিগ্রেসিভ’ বা পশ্চাদ্মুখী কর বলা হইয়া থাকে। যিনি সর্বোচ্চ হারে আয়কর জমা করেন, আর যাঁহার বাৎসরিক আয় করযোগ্যই হয় না— পণ্য ও পরিষেবা কিনিতে গেলে উভয়েই সমান হারে কর দিতে বাধ্য। কারণ, সেই কর ক্রেতার আয়, অর্থাৎ করপ্রদানের সামর্থ্য, দেখিয়া ধার্য হয় না— পণ্য বা পরিষেবার গোত্র অনুসারে পরোক্ষ কর বিন্যস্ত হয়। জিএসটি-র মাধ্যমে ভারত দুনিয়ার বৃহত্তম ‘পরোক্ষ কর ব্যবস্থা সংস্কার’ করিতে চলিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার এই চরিত্রদোষ সংশোধন সেই সংস্কারেরও সাধ্যাতীত। পরোক্ষ কর থাকিলে এই পশ্চাদ্মুখিতাও থাকিবে। তাহা হইলে প্রধানমন্ত্রী যে বলিতেছেন, জিএসটি-র মাধ্যমে দরিদ্রের উপর করের চাপ কমিবে, তাহা কি নেহাতই কথার কথা, অমিত শাহ যাহাকে ‘জুমলা’ বলেন? কথা ভাসাইয়া দেওয়ার অভ্যাস প্রধানমন্ত্রীর আছে, অনস্বীকার্য— কিন্তু, জিএসটি-র ক্ষেত্রে তাঁহার আশ্বাসটি একেবারে ভিত্তিহীন নহে। অন্তত, জিএসটি-র কাঠামোর মধ্যে সেই অবকাশ রহিয়াছে।
অবকাশটি পণ্য ও পরিষেবার জন্য পৃথক করের হারে। গোড়াতেই বলিয়া রাখা প্রয়োজন, জিএসটি-তে কোন করের কী হার হইবে, তাহা নির্দিষ্ট হইতে এখনও ঢের বাকি আছে। কিন্তু, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম কমিটির সুপারিশ বা জিএসটি-র হার সংক্রান্ত রাজনৈতিক আলোচনাগুলি যদি নির্দেশক হয়, তবে অনুমান করা চলে, বর্তমানে পণ্যের ওপর মোট যে পরিমাণ পরোক্ষ কর আদায় করা হয়, জিএসটি-র হার তাহার তুলনায় কম হইবে। পরিষেবার ক্ষেত্রে হিসাবটি বিপরীত— করের হার সম্ভবত বাড়িবে। জিএসটি যদি প্রকৃতই রাজস্ব-নিরপেক্ষ ব্যবস্থা হয়, তবে করের পাল্লা পণ্য হইতে পরিষেবার দিকে ঝুঁকিবে। তাহাতে দরিদ্র মানুষের লাভ। কারণ, তাঁহারা যে যৎসামান্য অর্থ ভোগব্যয় খাতে খরচ করিতে পারেন, তাহা মূলত পণ্য কিনিতেই চলিয়া যায়। বেশির ভাগ পরিষেবাই তাঁহাদের নাগালের বহু বাহিরে। ফলে, পণ্যের উপর কর আগের তুলনায় কমিলে দরিদ্র মানুষের উপর পরোক্ষ করের বোঝা খানিক হইলেও লাঘব হইবে। বস্তুত, এই ব্যবস্থাটি সামগ্রিক ভাবে পরোক্ষ করের পশ্চাদ্মুখী চরিত্র খানিক বদলাইয়া দিতে পারে। দরিদ্র মানুষ মূলত পণ্য কিনিলে সমপরিমাণ ব্যয়েও ধনীদের তুলনায় কম কর দিবেন। পরিবর্তনটি অবশ্য কঠিন নহে, বরং অতি সহজ— করের হার নির্ধারণে সামান্য হেরফের তাহার খাত ফের বদলাইয়া দিতে পারে। অতএব, জিএসটি পর্ষদের সচেতনতা জরুরি।
বস্তুত, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যক পণ্যের জন্য একটি পৃথক শ্রেণি প্রস্তুত করা বিধেয়। সুব্রহ্মণ্যমের সুপারিশেও এই গোত্রের পণ্যগুলির জন্য নিচু হারে করের কথা বলা হইয়াছে। শ্রেণিটি গঠন করিবার সময় সতর্ক থাকিতে হইবে। লাল স্বর্ণ চালের সহিত বাসমতীও যাহাতে শ্রেণিভুক্ত না হইয়া পড়ে, খেয়াল রাখা প্রয়োজন। জিএসটি একটি অ-পূর্ব সুযোগ আনিয়া দিয়াছে— পরোক্ষ করের ক্ষেত্রেও রামা কৈবর্তদের খানিক রেহাই দেওয়ার। পড়িয়া পাওয়া সুযোগটির সদ্ব্যবহার প্রয়োজন। তবে, তাহাতে মধ্যবিত্ত চটিবে, কারণ জিএসটি চালু হইলে তাহাদের উপর পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িবে। এই শ্রেণিকে চটাইবার রাজনৈতিক ঝুঁকি নেতারা লইতে পারিবেন?