Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পরিবার একমাত্র নেহরুর, তা তো নয়

নির্বাচনী প্রচারে কে হিটলার আর কে শাহজাদা, এই নিয়ে বিশেষণগুলো বাদ দিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপিকে যদি দাঁড়িপাল্লায় তোলা যায়, তা হলে দেখা যাবে, দেশে যে অর্থনৈতিক সংস্কার চলছে, উভয়েই তার প্রবল সমর্থক। দেবেশ রায়নির্বাচনী ইস্তেহারকে অনেকেই হয়তো বাঁধা গতের নামতা মনে করেন। যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের ভোটেরও সংখ্যা বাড়ছে, নির্বাচনী ইস্তেহারের ধরন কিন্তু ততই পাল্টাচ্ছে। দুটো দিক থেকে নির্বাচনী ইস্তেহার খুব জরুরি।

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

নির্বাচনী ইস্তেহারকে অনেকেই হয়তো বাঁধা গতের নামতা মনে করেন। যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের ভোটেরও সংখ্যা বাড়ছে, নির্বাচনী ইস্তেহারের ধরন কিন্তু ততই পাল্টাচ্ছে। দুটো দিক থেকে নির্বাচনী ইস্তেহার খুব জরুরি। কোন দল কী ভেবে ভোটে লড়ছে, ইস্তেহারই হচ্ছে তার প্রাথমিক দলিল। এখনকার জন্য ও ভবিষ্যতের জন্য। আর, যে দলই সরকার তৈরি করুক, তাদের এই ইস্তেহার অনুযায়ী তারা লোকসভায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকে ও কৈফিয়ত চাওয়া হয় তাদের কাছে, এই ইস্তেহার ধরেই।

কংগ্রেস ও বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহার এখনও বের করেনি। কিন্তু প্রচার থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই দুই দল সম্পূর্ণ উল্টো দিক থেকে ভোটে নেমেছে। বিজেপির প্রধান বিষয় রাজনীতি ও শাসন। শাসননীতির পক্ষাঘাত বলে একটি কথা এখন খুব চলছে ইউপিএ-২-এর ব্যর্থতা বোঝাতে। বিজেপির প্রধান প্রচারক ও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী শক্তপোক্ত শাসনের আশ্বাস দিচ্ছেন। তার সঙ্গে আরও দুটো বিষয় যুক্ত হয়েছে। সরকারের ও কংগ্রেসের মধ্যে দুর্নীতি, আর নেহরু পরিবারের বংশানুক্রমিক আধিপত্য। অর্থনীতির ব্যাপারে তাঁরা কোনও বিশদে যাননি। ‘গুজরাত মডেল’ বলে কিছু একটা বুঝিয়েছেন তাঁরা, কিন্তু ‘মডেল’টা যে কী, সেটা তাঁদের কথা থেকে ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। কতকগুলি বিষয় কংগ্রেসের প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছে। ব্যবসাবাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলা স্তরের ক্ষমতা বাড়ানো, সমস্ত রকম খাদ্যশস্যকে বিমার আওতায় নিয়ে আসা, গুদামঘরের ওপর মালিকের স্বত্ব না কমিয়ে কৃষকের দখলও বাড়ানো, গ্যাসের দরের স্থিরতার জন্য একটাই নীতি স্থির করা, স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্য ক্যাপিটেশন ফি একেবারে তুলে দেওয়া, মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ রোজগার যোজনার কামাই-বরাদ্দ বাড়িয়ে দু’শো দিন করা।

নির্বাচনী প্রচারে কে হিটলার আর কে শাহজাদা এই নিয়ে বিশেষণগুলো বাদ দিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপি এই দু’টি রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্রকে যদি দাঁড়িপাল্লায় তোলা যায়, তা হলে দেখা যাবে, দেশে যে অর্থনৈতিক সংস্কার চলছে, এই দুই কেন্দ্রই তার প্রবল সমর্থক। আঞ্চলিক দলগুলিও তাই। একমাত্র বামপন্থীরা ভাবেন, এই অর্থনৈতিক নীতি দেশের অর্থনীতির ওপর বিদেশের প্রভাব বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাঁরা এ কথাটা খুব বিশ্বাস্য করে তুলতে পারছেন না। কংগ্রেস মনে করছে, তাদের নেতৃত্বে নব্বইয়ের দশকে এই আর্থিক সংস্কার শুরু হয়েছে। তাদেরই দায়িত্ব সেই সংস্কারকে তার যুক্তিপূর্ণ পথে এগিয়ে নেওয়া। বিজেপি মনে করছে, সেই কাজের জন্য নেহরুবংশমুক্ত, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিহীন, দুর্নীতিরহিত ও দৃঢ় প্রশাসনের সরকার দরকার।

বিবাদ ও পার্থক্য তা হলে লক্ষ্য নিয়ে নয় আদৌ। পদ্ধতি নিয়েও নয়। এই দুটোতেই তাঁরা একমত, মুখে বলুন চাই না-ই বলুন। এই কাজটা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধ, দুর্নীতি রোধ, অশাসন রোধ কে করতে পারবে? জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়াটা ঠেকানোর ক্ষমতা কংগ্রেস, বিজেপি বা কোনও দলের সরকারেরই নেই। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। কিন্তু এ বিষয়ে নিজের দেখাশোনা বুঝতে গিয়ে মনে হয়েছে, এই দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিতে শহরের ও শহরের কাছাকাছি গরিব মানুষজনের হাতেও কিছু টাকা এসেছে। এখন ক্রমেই, সব অঞ্চলেই নানা সূত্রে শহরের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। তেমন ক্রমবর্ধমান শহুরে এলাকায় পরিষেবা ধরনের কাজে একটু গরিব মেয়েরা অনেক বেশি সংগঠিত। হাসপাতাল, নার্সিং হোম ইত্যাদির প্রসার মেয়েদের পরিষেবা সংক্রান্ত কাজে সংগঠিত করে তুলছে। সেই নতুন ক্রেতারা জিনিসের দাম চড়া রাখবেন। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলি রেশন দোকান মারফত কিছু জিনিস নিয়ন্ত্রিত দরে দিয়ে বাজারের ওপর একটা পরোক্ষ চাপ তৈরি করতে পারেন, যাতে জিনিসপত্রের দর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। সেই প্রক্রিয়ায় ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যে রমন সিংহের মতো দক্ষ প্রশাসক ও অঞ্চল-সচেতন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দু’টাকা কেজি দরে চাল মানুষজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু রাজস্থানে বা দিল্লিতে বা কর্নাটকে এমন কোনও উদ্যোগ কার্যকর হবে না জনবিন্যাস বা বসতি বিন্যাসের জগাখিচুড়ি ধরনের জন্যই। জিনিসপত্রের দর বাড়ার ছকটা বুঝতে কিছু দিন একটি আর্থিক-দৈনিক কাগজে প্রকাশিত ও সারা ভারতের বিভিন্ন মান্ডি-র পাইকারি দরের তালিকা তুলনার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, সারা ভারতে পাইকারি দরের রাজ্য বা রাজ্যের ভিতরের অঞ্চলওয়াড়ি কোনও পার্থক্য ঘটে না। বাজার দরের এমন সর্বভারতীয় ঐক্য একটি রাজ্য সরকার কী করে ভাঙবে?

শাসন পরিচালনায় পক্ষাঘাতের একটা রটনা ইউপিএ-২ সরকারের বিরুদ্ধে বেশ চড়া সুরে বাঁধা হয়েছে। কিন্তু ইউপিএ তো একটা জোট-সরকার। সেই জোট-সরকারের অংশীদাররাই যদি নিজেদের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রকের শাসন-পরিচালনা ভেঙে দেন, তা হলে সেই দায় বইবে কে? ইউপিএ-২-এর অ-শাসনের দায় তার শরিকদের নয় কেন?

কমনওয়েলথ গেমসের টাকা মেরে দেওয়া, বা টু-জি বরাত পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়া, বা কর্নাটকে রেড্ডিদের খনির বরাত দেওয়ার জন্য টাকা খাওয়া এগুলোকে নিশ্চয়ই উন্নয়ন ও উত্‌পাদনের আনুষঙ্গিক বলে ব্যাখ্যা দেওয়া নয়। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে ইউপিএ-২ সরকারের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ নিয়ে নিঃসংশয় হওয়াও কঠিন। এবং, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর মন্ত্রিসভায় ডি এম কে-র এক সদস্যের টুজি-র ঘুষ খাওয়ার দোষ প্রাথমিক ভাবে প্রমাণ হতেই তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন। টুজি-র ব্যাপারে এক জন অব্যবহিত মন্ত্রী ও ভারতের এক জন প্রধান ও প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার মেয়েকে দিনের পর দিন জেলে থাকতে হয়েছে। করুণানিধি নিজে দিল্লিতে এসেও তাঁদের জামিনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। মনমোহন সিংহ ও তাঁর সরকার কোনও ভাবে শাসনপ্রক্রিয়া ও আইনি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। অন্তত, কিছু দিন পর একটা জামিনের ব্যবস্থা করার চেষ্টাও তাঁরা করেননি। কংগ্রেস কমনওয়েলথ গেমসের টাকা মেরে দেওয়া সন্দেহে অভিযুক্ত কালামাদিকে দাঁড় করাননি, যদিও মামা বনশলকে করেছেন। বিজেপি দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত ইয়েদুরাপ্পাকে দলে ফিরিয়েছে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রেড্ডি ভাইদের প্রধান প্রতিনিধি রামালুকে দাঁড় করিয়েছে। শাসন বা সরকার চালানো রাজনীতি-নিরপেক্ষ থাকছে না, অথচ শাসনব্যবস্থায় পক্ষাঘাতের অভিযোগ করছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর নিজের বেলায় কী হয়েছে?

জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের সচিব সরিতা জে দাস দাঙ্গার মধ্যেই ২০০২-এ গুজরাতে গিয়েছিলেন। তিনি তখনই জানিয়েছিলেন, গুজরাতে কিছুতেই তাঁকে দাঙ্গা-আক্রান্তদের আশ্রয়-শিবিরগুলিতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন্দ্রে তো তখন এনডিএ-এর সরকার। সরিতা জে দাস দিল্লিতে ফিরে এসে সংখ্যালঘু কমিশনের কাছে তাঁর রিপোর্ট জমা দেন। সেই রিপোর্টে তিনি দ্বিধাহীন সুপারিশ করেন যে, গুজরাতে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হোক। গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তৈরি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম সবিতা জে দাসের রিপোর্টটি পায়নি। সরিতা বলেছেন, তিনি গুজরাতের মুখ্য সচিবকে একটি কপি পাঠিয়েছেন। সেটা কোথায় গেল? এমন একটি রিপোর্ট ফাইল থেকে উধাও হয়ে গেল? শুধু উধাও হয়ে গেল তাই নয়, সেই জায়গায় তারলোচন সিংহ নামে এক জনের রিপোর্ট ফাইল করা আছে।

২০১৪-এর লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিপর্বের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। জোট বাঁধা-জোট ছাড়াছাড়ি চুকে গেছে। কে কোথায় দাঁড়াচ্ছেন, সে সবও মোটামুটি পাকা হয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র জমা পড়তে শুরু করেছে। কোন পার্টি কী লক্ষ্য নিয়ে ভোট করছে? বামপন্থীরা ঘোষণা করেছেন যে, তাঁরা বিজেপি ও কংগ্রেস ছাড়া একটা কেন্দ্রীয় সরকার চান। কংগ্রেস পরিষ্কার করেছে, অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে সারা দেশের যে-৭০ কোটি ভোটার দারিদ্রসীমানা পেরোলেও এখনও মধ্যবিত্ত হয়ে উঠতে পারেননি, তাঁদের মধ্যবিত্ত হওয়ার সুবিধে করে দিতে হবে।

সবচেয়ে অস্পষ্ট বিজেপি। তারা একটা হাওয়া তুলেছে। হাওয়া তো নানা কারণেই ওঠে। আমরা, বাংলার মানুষ তো জল-হাওয়ার দেশের মানুষ। হাওয়ার খেলা আমাদের নিত্যকার ঘটনা। মৌসুমি ঘোর বর্ষণ বঙ্গোপসাগরের কোনও এক নিম্নচাপের গোঁয়ার্তুমিতে আটকে গেল। পশ্চিমের ঠান্ডা হাওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছে কোনও উচ্চ চাপ, তাই ঠান্ডা আর তত ঠান্ডা হয় না। কোনও হাওয়া জলীয় বাষ্প ঠাসা মেঘ ভাঙন উত্তরবঙ্গে আর গঙ্গার দক্ষিণপারে তখন খরা চলছে। বিজেপির হাওয়াটার আসল নাম নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু হাওয়ার ব্যাকরণে এমন কোনও নাম অচল। সেখানে বলতে হবে উচ্চ চাপ না নিম্ন চাপ, জলীয় বাষ্প ভরা নাকি শুকনো বাতাসে ঠাসা, পশ্চিমি না পুব। সেই ব্যাকরণ রক্ষা করতেই এমন একটা লেবেল সাঁটা হয়েছে নেহরু পরিবারের আধিপত্যমুক্ত, দুর্নীতিহীন, শস্তা বাজারের কড়া সরকার। এই লেবেলের মুশকিলটা হল, দেখা যাচ্ছে পরিবার একমাত্র নেহরুরই থাকে না, দুর্নীতির গতি সর্বত্রগামী, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ঠিক পাবলিক সেক্টরের অন্তর্গত নয় আর সরকারের কড়ি প্রায় সর্বত্রই কোমল-নির্ভর।

ভোটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ‘হাওয়া’ কি ক্রমেই মরে আসবে, যেমন মরে এসেছে গুজরাত মডেল? যেমন উঠে আসছে গুজরাত দাঙ্গা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial debesh roy election campaign
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE