Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

বাজেট বিষয়ে যে কথাগুলো জানা ভাল

আয়কর আর জিডিপির বৃদ্ধি হার, এটুকুই কিন্তু বাজেটের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।আয়করে কিছু বাড়তি ছাড় পাওয়া গেল কি না, এটুকুর বাইরে বাজেট নিয়ে আমজনতার বিশেষ আগ্রহ নেই। থাকার কথাও নয়। জিডিপি-র মারপ্যাঁচ আর রাজকোষ ঘাটতি, বিনিয়োগের হযবরল নিয়ে খামখা রাতের ঘুম নষ্ট করে কে? কিন্তু, এই অনাগ্রহের ফাঁক গলেই এমন অনেক কিছু ঘটে যায়, যেগুলো আপনার-আমার জানা দরকার, কিন্তু আমরা জানি না। তেমনই কয়েকটা বিষয়ের কথা বলব।

আলোক রায়
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

আয়করে কিছু বাড়তি ছাড় পাওয়া গেল কি না, এটুকুর বাইরে বাজেট নিয়ে আমজনতার বিশেষ আগ্রহ নেই। থাকার কথাও নয়। জিডিপি-র মারপ্যাঁচ আর রাজকোষ ঘাটতি, বিনিয়োগের হযবরল নিয়ে খামখা রাতের ঘুম নষ্ট করে কে? কিন্তু, এই অনাগ্রহের ফাঁক গলেই এমন অনেক কিছু ঘটে যায়, যেগুলো আপনার-আমার জানা দরকার, কিন্তু আমরা জানি না। তেমনই কয়েকটা বিষয়ের কথা বলব।

প্রথম কথা, আমরা যারা মোটের ওপর সচ্ছল, তারা মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করি, আমাদের রক্ত জল করা রোজগার থেকে আমরা কর দিয়ে মরি, আর গরিবরা দিব্যি নিখরচায় হাজার সুবিধা পায়। কথাটা ঠিক নয়। গরিব মানুষকেও কর দিতে হয়। উৎপাদন শুল্ক, বিক্রয় কর, ‘ভ্যাট’ বা যুক্তমূল্য করের মতো পরোক্ষ কর গরিব-বড়লোক দেখে না। গরিব মানুষ যখনই প্যাকেজড পণ্য কেনেন, যেমন ওষুধ, সাবান বা বিস্কুট, অথবা মোবাইল ফোন রিচার্জের মতো কোনও পরিষেবার দাম মেটান, তখন প্রত্যেক বার তাঁদেরও পরোক্ষ করগুলো দিতে হয়। বড়লোকের তুলনায় গরিব নিজেদের রোজগারের অনেক বেশি অংশ নানা পণ্য কিনতে ব্যয় করেন, ফলে হিসেব কষলে হয়তো দেখা যাবে, আয়ের শতাংশ হিসেবে বড়লোকদের তুলনায় গরিবই বেশি কর দিচ্ছেন। মনে রাখা ভাল, দেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন। ডাক্তার, উকিল, কনসালট্যান্ট, গৃহশিক্ষকদের মতো বহু স্বনিযুক্ত মানুষ প্রকৃত রোজগার চেপে যেতে পারেন। ভারতে কৃষি আয়ে কর নেই। পঞ্জাব হরিয়ানায় প্রাসাদনিবাসী চাষিরাও এক পয়সা আয়কর দেন না।

ভর্তুকির কথা বলি। দরিদ্র থেকে লক্ষপতি, সবাই এলপিজির সিলিন্ডারে সমান ভর্তুকি পান। সরকারি স্কুলকলেজে বড়লোকের ছেলেমেয়েরাও নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করে। আমার ছেলে যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ত। মাসে ৫০ টাকা টিউশন ফি। ধনী চাষি অনেক বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন, ফলে এই সারের ভর্তুকি গরিবের তুলনায় বড়লোক চাষিদের পকেটেই পৌঁছয় অনেক বেশি। কাজেই, গরিবরা কর না দিয়ে সব কিছু নিখরচায় পেয়ে যাচ্ছে, এমন কথা বলার আগে দু’বার ভেবে নেওয়া ভাল।

দ্বিতীয় কথা, যে নীতি ‘গ্রোথ’ বা আর্থিক বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকে থাকে, তা দ্রুত বিনিয়োগ-বান্ধব ও দরিদ্র-বিরোধী নীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কিন্তু, মানুষকে দারিদ্রের বাইরে নিয়ে আসতে হলে উৎপাদনশীল চাকরির ব্যবস্থা করতেই হবে। সে জন্য বৃদ্ধির বিকল্প নেই। অতএব, শিল্পবান্ধব নীতি দরিদ্রবান্ধবও বটে। ভারতের মতো দরিদ্রবহুল দেশে শুধু আর্থিক বৃদ্ধি দিয়েই অন্তত অদূর ভবিষ্যতে দারিদ্রের সমস্যার সমাধান করে ফেলা যাবে না, সে কথা অনস্বীকার্য। গরিবের জন্য খাদ্যে ভর্তুকি, বা অপেক্ষাকৃত কম কর্মসংস্থানের মাসগুলিতে নিশ্চিত কাজের ব্যবস্থা জরুরি। কিন্তু যে নীতি ভারতকে বিনিয়োগের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করবে, সেটাকেই দরিদ্রের পরিপন্থী বলে দাগিয়ে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই।

তিন, যোজনা ব্যয় এবং যোজনাবহির্ভূত ব্যয় নিয়েও ভুল ধারণা আছে। যোজনা খাতে ব্যয় মূলত উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হয়, আর যোজনাবহির্ভূত ব্যয় হল মূলত বিভিন্ন পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। ধরেই নেওয়া হয়, দ্বিতীয় ব্যয়ের তুলনায় প্রথমটা ভাল, বা বেশি জরুরি। কিন্তু কেন? নতুন রাস্তা বা হাসপাতাল তৈরি করা কেন পুরনো রাস্তা বা হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে? বরং, নতুন নির্মাণে এক টাকা খরচ করলে যত সামাজিক লাভ, পুরনো পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে সেই টাকা খরচ করলে বহু ক্ষেত্রে সামাজিক লাভ বেশি হবে। কেন যোজনা ব্যয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার কারণ সম্ভবত অন্যত্র। নতুন বিনিয়োগ হলে সরকারি দফতরগুলোর পোয়াবারো। তাতে অনেক বেশি ‘কাট মানি’ আদায় করা যায়।

শেষে বলি, অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে তাঁরা দেশের মোট রাজস্বে রাজ্যগুলির হিস্সা ৩২ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করে দিয়েছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেননি যে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির খাতে এত দিন কেন্দ্রের থেকে রাজ্যগুলি যে টাকা পেত, এ বার থেকে তার অনেকটাই কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ছবিটা কী রকম দাঁড়াল, তার বিবিধ হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। একটা হিসেবে দেখছি, গত বছর কেন্দ্রের হাতে এক টাকা থাকলে রাজ্যগুলি তার থেকে ৩৬ পয়সা পেত, এ বার পাচ্ছে ৩৭ পয়সা। কাজেই, রাজ্যগুলির হাতে যে টাকা বাড়ল, তা অতি সামান্য। অর্থমন্ত্রীর গালভরা দাবির সঙ্গে বাস্তব প্রাপ্তির মিল নেই। তবে, রাজ্যগুলির হাতে মোট টাকার অঙ্ক প্রায় সমান থাকলেও এ বার তাদের স্বাধীনতা অনেক বেশি। কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, রাজ্যই স্থির করবে। এর ভাল আর মন্দ, দুই দিকই আছে। এই টাকায় কোনও রাজ্য সম্পদ তৈরি করতে পারে, ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে পারে। আবার, অন্য কোনও ভোটের আগে মানুষের মন পেতে এই টাকাটা উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই বাজে খরচের পর সে রাজ্যগুলোর আর অভিযোগ করার উপায় থাকবে না যে কেন্দ্র তাদের দরকারের কথা না ভেবেই বিভিন্ন প্রকল্প চাপিয়ে দেয়।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা-য় অর্থনীতির ভূতপূর্ব শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

alok roy post editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE