ভারতরত্ন নামক সম্মানটি যদি মরণোত্তরও মিলিতে পারে, গৌতম বুদ্ধই বা তাহা হইলে বাদ পড়িবেন কেন? শাসকদের ইতিহাসবোধ আড়াই হাজার বত্সরের গণ্ডি টপকাইতে না পারিলে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর দাবিটিও বিচার করিয়া দেখা যায়। অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল, রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষেই, গলা খাঁকরাইয়া উত্তর করিবে, বুদ্ধ হইতে গাঁধী, প্রত্যেকেই ভারতরত্নের ঊর্ধ্বে। তাহা হইলে পুরস্কারটি কাহাদের জন্য? যে পুরস্কারের প্রাপক-তালিকায় একই সঙ্গে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ও মারুধর গোপালন রামচন্দ্রন, অমর্ত্য সেন ও বিসমিল্লা খান থাকিতে পারেন; যে পুরস্কারটি চিন্তামণি নাগেশ রামচন্দ্র রাও পান অথচ শ্রীনিবাস রামানুজন পান না, সেই পুরস্কারের জাতবিচার করা অতি দুরূহ কার্য। বরং, ১৯৫৪ হইতে ২০১৪ পর্যন্ত যে ৪৫ জন এই পুরস্কার পাইয়াছেন, সেই তালিকা দেখিলে অনুমান করা চলে, ইহা বহুলাংশেই রাজনৈতিক নেতাদের অবসরভাতার অংশবিশেষ। দেশের ১৪ জন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অর্ধেকই ভারতরত্ন। বস্তুত, তালিকাটি দেখিলে প্রশ্ন জাগিতে পারে, রাজনীতির খনিই বুঝি ভারতের একমাত্র রত্নভাণ্ডার। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই খনি হইতেই আরও দুই রত্ন পাইয়াছে।
সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতাপ্রসূত একটি পুরস্কারের যাহা ভবিতব্য, ভারতরত্নেরও তাহাই হইয়াছে। পুরস্কারটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত। এমন একটি অবান্তর সম্মান বজায় রাখা, এবং সেই সম্মানকে মরণোত্তর শ্রেণিতেও লইয়া যাওয়ার কৃতিত্ব যেমন কংগ্রেসের, তাহাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক করিয়া তুলিবার কাজটিও ভারতের প্রাচীনতম দলটিই করিয়াছে। নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বে নিজেকে ‘ভারতরত্ন’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছেন স্বয়ং জওহরলাল নেহরু। তাঁহার কন্যাও সেই পথেই হাঁটিয়াছেন। পুরুষোত্তম দাস টন্ডন হইতে কুমারস্বামী কামরাজ, অনেক ভারতরত্নই প্রকৃত প্রস্তাবে কংগ্রেসরত্ন। অন্য দলগুলি ক্ষমতায় আসিয়া খেলাটি ধরিয়া লইয়াছে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় জয়প্রকাশ নারায়ণ ভারতরত্ন হইয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বাজপেয়ী হইলেন। সঙ্গে মদনমোহন মালবীয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে যে নেতারা নেহরুতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়াইয়া হিন্দুত্ববাদের কথা বলিয়াছিলেন, বিজেপি-র তাঁহাদের আত্মস্থ করিয়া লইবার প্রক্রিয়ায় মালবীয় নূতনতম নাম। বল্লভভাই পটেলের তুলনায় তাঁহার উপর হিন্দুত্ববাদীদের দাবি বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদী সেই দাবি মিটাইয়াছেন। ভবিষ্যতে ভারতরত্ন প্রাপকের তালিকায় কেশব বালিরাম হেডগেওয়ার বা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের নাম থাকিলেও বিস্ময়ের কারণ থাকিবে না। আপত্তিরও নহে। রাজীব গাঁধী ভারতরত্ন হইলে অন্যদেরই বা হইতে বাধা কোথায়?
বস্তুত, ভারতরত্নের কুনাট্য দেখিলে প্রত্যয় জন্মে, ভাইচুং ভুটিয়াকে ডি লিট প্রদান করিয়া বঙ্গেশ্বরী নূতন কিছু করেন নাই। দেশের সর্বোচ্চ সম্মানটিই যখন কোনও কৃতিত্বের দাবি না করিয়াই দেওয়া চলে, তখন সামান্য ডি লিট আর এমন কী? তবে, নরেন্দ্র মোদীও যে কুনাট্যের ট্র্যাডিশনটি ছাড়িতে পারিলেন না, তাহা দুঃখের। গত বত্সর সচিন তেন্ডুলকর অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহাকে ভারতরত্ন ঘোষণা করিয়া ইউপিএ সরকার পুরস্কারটিকে খেলো করিয়াছিল। এই বত্সর দুই প্রাপককে পুরস্কারটি জন্মদিনের উপহার দেওয়া হইল। এহেন বালখিল্য পারিতোষিক বিতরণীর পরে আর সম্মানটির কোনও গুরুত্ব অবশিষ্ট থাকে কি? যদি দেশে তেমন রত্ন না থাকে, তবে পুরস্কার না দেওয়াই বিধেয়। তবে, রাজনীতির খনি, মতান্তরে কূপ, হইতে রত্ন উত্তোলনের প্রক্রিয়াটি জারি থাকিলে ভিন্ন কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy