Advertisement
E-Paper

বাংলার পাখি ‘চড়াই’

আমাদের দল ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের নানা জায়গা থেকে চটাস চটাস আওয়াজ উঠছে। অনেককে চড় মারছি। আরও মারব।আরে লেকটাউনের ওখানটা দিয়ে কুড়ি বছর ধরে ইউ-টার্ন নিচ্ছি, কেউ কিছু বলেনি, হঠাত্‌ কথা নেই বার্তা নেই, ট্রাফিক কনস্টেবলটা আমাকে ধরল। মাথা গরম হয়ে গেল। স্বাভাবিক, আমি তো খেলোয়াড়। খেলোয়াড়ের কাজই হল মাথা গরম করা। তার পর হাত পা চালিয়ে দেওয়া। এই তো বছর দুয়েক আগে মারাদোনা একটা রিপোর্টারকে ঠাটিয়ে চড় মারল, সে নাকি মারাদোনার বউকে চোখ মারছিল।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

আরে লেকটাউনের ওখানটা দিয়ে কুড়ি বছর ধরে ইউ-টার্ন নিচ্ছি, কেউ কিছু বলেনি, হঠাত্‌ কথা নেই বার্তা নেই, ট্রাফিক কনস্টেবলটা আমাকে ধরল। মাথা গরম হয়ে গেল। স্বাভাবিক, আমি তো খেলোয়াড়। খেলোয়াড়ের কাজই হল মাথা গরম করা। তার পর হাত পা চালিয়ে দেওয়া। এই তো বছর দুয়েক আগে মারাদোনা একটা রিপোর্টারকে ঠাটিয়ে চড় মারল, সে নাকি মারাদোনার বউকে চোখ মারছিল। এই ঔদ্ধত্য আমাদের খেলাগত অধিকার। খেলা হচ্ছে যুদ্ধ। এখানে রক্ত গরম না থাকলে তুমি টিকতেই পারবে না। গোটা শরীর দিয়ে ক্রোধকে, আগ্রাসনকে, বিরোধীকে থেঁতো করে দেওয়ার স্পৃহাকে উদযাপন করতে হবে। তাই খেলাধুলোয় র্যান্ডম খিস্তি, মারপিট। ক্রিকেটে স্লেজিং একটা শিল্প। ফুটবলে শিনবোন ভেঙে দেওয়া, লিগামেন্ট ছিঁড়ে দেওয়া, এমনকী কামড়ে দেওয়া নাগাড়ে চলছে। জীবনেও আমরা প্রতিটি মুহূর্তে স্পোর্টসম্যান। তাই নখ-দাঁত বের করেই আছি। কিছু বললেই ঘ্যঁাক। আসলে আমরা তো মিনমিনে নই, রেগুলার ব্যায়াম-ফ্যায়াম করি, ভেতরটা চনচন করে ফোটে, এনার্জিটা গা ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। তা নিয়ে হল্লা মচালে চলে না।

চড় খুব উপকারী জিনিস। আমাদের দিদি এক বার ক্যামেরাম্যানদের বলেছিলেন চড় মারবেন। একটা পুলিশকে বলেছিলেন, তাদের ধরে চাবকাতে হয়। চাবুক দিয়ে চড় আর কী। সব চড় অবশ্য ভাল নয়। এই তো দিদির ভাইপোকে কে যেন একটা চড় কষিয়ে দিল সে দিন, মঞ্চে উঠে। সে ব্যাটাকে ওখানেই খুন করে ফেলা উচিত ছিল। কী আস্পদ্দা! তুই গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিবাদ কর, তা নয়, ফিজিকাল ভায়োলেন্স! ছিঃ, স্যাভেজ লোক সব, সভ্যতা শেখেনি, সংযম শেখেনি, ভেবেছে মসীর চেয়ে পেশি বড়। কিন্তু নেতা যদি কাউকে সটান চড় মারে? আর চড়-খাওয়া লোকটা যদি তক্ষুনি লেবেল পায় সিপিএমের লোক বা বিজেপির আদমি? তা হলে সেটা উচিত কাজ, চমত্‌কার কর্ম।

যে পলিটিক্স করে, সে জগ ছুড়তে পারে, গালাগাল দিতে পারে, হাঁড়ি মাথায় নাচতে পারে। আমাদের দল ক্ষমতায় আসার পর তো রাজ্যের নানা জায়গা থেকে চটাস চটাস আওয়াজ উঠছে। আমরা বিদ্যুত্‌ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারকে, নিবেদিতা সেতুর ওখানে কর্মীকে, খিদিরপুরের পুলিশকে সপাটে চড় মারছি। আরও মারব। কিচ্ছু দোষ হবে না। কারণ কী? কারণ পলিটিশিয়ানের মাথায় প্রতি মুর্হূতে হাজারটা দুশ্চিন্তা টগবগ করছে, কোটিখানেক টেনশন দোদমা ফাটাচ্ছে। সে নর্মাল ব্যবহার করবে কী করে? সকালে উঠেই মনে পড়ে, আজ মানুষের ভাল করতে হবে। মানুষের ভাল করা সোজা কথা? পাহাড়-ফাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে মিটিং করো রে, বস্তা বস্তা টাকা ঘাড়ে বয়ে বাড়িতে আনো রে, বাইপাসের হোটেলে বিনিপয়সায় মশলাদার ডিনার আর গ্যাসের-ব্যথা বাড়ানো ব্রেকফাস্ট খাও রে, রাত জেগে ফুর্তি করো রে। গাধা নিন্দুক বলবে, এ তো খেটেখুটে নিজের ভাল করলেন। আরে, নিজে বলে কি মানুষ নয়?

যা জমানা পড়েছে, রাজনীতির মধু খেতে ফিল্মস্টার, কবি, খেলোয়াড়, সবাই নিজের কাজফাজ গোল্লায় দিয়ে মানুষের ভাল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রেশারও বাড়ছে। শত্রুও। আবার আমাদের দল থেকে কারা সব ভেঙে বেরিয়ে অন্য দলে চলে যাচ্ছে। একদম ফুটবলের মতোই। আগে দলবদলের সময় কী ড্রামা চলত! কাউকে তালা দিয়ে আটক রাখা হচ্ছে, কেউ রাতারাতি কিডন্যাপ, কাউকে ইমোশনের ছলোছলো টোপ দেওয়া হচ্ছে। এখন সে সব তো আছেই, সঙ্গে আবার স্টেটমেন্ট দেওয়ার দায়। যে অন্য দলে গেল, তার নামে চাঁচাছোলা খারাপ কথা বলতে হবে। যে অন্য দল থেকে এই দলে এল, তাকে বাছাবাছা প্রশংসা করে, লাভের গুড়ের ভাগ দিতে হবে। তাই আমাদের ব্যবহারের সঙ্গে কেরানির উচিত-ব্যবহার গুলিয়ে ফেললে চলবে না। আমরা সারা ক্ষণ এমন স্ট্রেস আর খারাখারির মধ্যে চিপকে আছি, মাইকের সামনে শুধু শালা বলেই যে থেমে যাচ্ছি, বাকি লাগসই কথা গপাত্‌ গিলে নিচ্ছি টাইমলি, এ জন্যে প্রাইজ দেওয়া উচিত।

কম্পিটিশন সাংঘাতিক। গৌতমের সঙ্গে আমার এক সময় এমন বোঝাপড়া ছিল, আমি বল ধরার আগে গৌতম বুঝে যেত কোথায় পাস বাড়াব। দৌড় শুরুর আগে বুঝত, কোথায় পোজিশন নিচ্ছি। আমরা দুজন থাকলে মাঝমাঠে আর কেউ ট্যঁা-ফোঁ করতে পারত না। পলিটিক্সের ময়দানে অবশ্য আমি আগে দখল নিয়ে নিলাম। একদম গোওওল। সাংসদ। তাই ক্রীড়ামন্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর গৌতম প্রাণপণ চেষ্টা করল আমার কাছ থেকে বল কেড়ে, সেরা লিংকম্যান হয়ে উঠতে। কিন্তু ব্যাপারটা জমল না। ফুটবলারদের দিনকাল এখন স্পেশাল খারাপ যাচ্ছে। কোত্থেকে একটা গোয়েন্দার দল এসেছে, আমাদের পার্টির পেছনে লাগার জন্য, তারা আমাদের আদরের ক্লাবটাকেও ছেড়ে কথা বলছে না। এ ভাবে সারা ক্ষণ চক্রান্ত ডজ করতে করতে বাঁচা যায়, না ইউ-টার্ন নেওয়া যায়?

মানুষের মধ্যে থেকে এ সব বোঝার বুদ্ধি, দরদ চলে গেছে। শ্রদ্ধাও চলে গেছে। কনস্টেবলটা আমাকে চিনে সুড়সুড় করে রাস্তা ছেড়ে দিতে পারল না? আমি একটা ব্যস্ত ভিআইপি, আমি সবার মতো নিয়ম মেনে গাড়ি চড়ব? এই দেশে রাজারাজড়া দেখলেই নিচু হয়ে লাল ফেলার, অন্যায় সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার একটা ঐতিহ্য আছে, সেটাকে অগ্রাহ্য করল? তা ছাড়া, এক গালে চড় মারার পর অন্য গাল বাড়াতে পারল না? মহাপুরুষদের আদর্শ জানে না? নির্ঘাত ব্যাটা সিপিএম। প্লাস আধপাগলা। জেনারেল নলেজ নেই। জিজ্ঞেস করো জাতীয় পাখি কী, শিয়োর বলবে ময়ূর। জানেও না, আমরা ক্ষমতা পাওয়ার পর, বাংলার জাতীয় পাখি হয়েছে ‘চড়াই’!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy