Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

বচ্ছরকার দিনটায় একটু দুঃখ হয়, রাগও

শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি বলতে পার্টির কর্তারা যা বুঝতেন, তার ধার এবং ভার দুইই গেছে, ভূত পিষে আর এক ফোঁটা তেলও বেরোবে না। ওঁদের মনটাই জুরাসিক যুগের। শ্রমিক আন্দোলন সেখান থেকে মুক্তি না পেলে তার মৃত্যু অবধারিত। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ভোটের বাজারে আর কান পাতা যাচ্ছে না, এ দিকে মে দিবস সমাগত। মন দিয়ে সিপিআইএমের নির্বাচনী ইস্তাহার পড়ছিলাম। গোড়ার দিকে একটি অনুচ্ছেদ আছে, যার শিরোনাম ওয়ার্কার্স: লুজিং আউট। বক্তব্য: কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নিয়ো-লিবারেল’ আর্থিক নীতি শ্রমিকদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। আশির দশকের গোড়ায় এ দেশের সংগঠিত শিল্পে মোট আয়ের মধ্যে শতকরা ত্রিশ টাকা শ্রমিকদের হাতে আসত, এখন আসে শতকরা দশ। বেশির ভাগ দেশে এই অনুপাত আমাদের চেয়ে বেশি।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

ভোটের বাজারে আর কান পাতা যাচ্ছে না, এ দিকে মে দিবস সমাগত। মন দিয়ে সিপিআইএমের নির্বাচনী ইস্তাহার পড়ছিলাম। গোড়ার দিকে একটি অনুচ্ছেদ আছে, যার শিরোনাম ওয়ার্কার্স: লুজিং আউট। বক্তব্য: কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নিয়ো-লিবারেল’ আর্থিক নীতি শ্রমিকদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। আশির দশকের গোড়ায় এ দেশের সংগঠিত শিল্পে মোট আয়ের মধ্যে শতকরা ত্রিশ টাকা শ্রমিকদের হাতে আসত, এখন আসে শতকরা দশ। বেশির ভাগ দেশে এই অনুপাত আমাদের চেয়ে বেশি। এ তো গেল সংগঠিত শিল্পের কথা। সে আর কতটুকু? বাকি খবর আরও খারাপ। সর্বত্র চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বাড়ছে, বেড়ে চলেছে ঠিকা শ্রমিকদের অনুপাত, তাঁদের ন্যূনতম প্রাপ্য থেকে শুরু করে সুরক্ষার কোনও নিয়মকানুনই ঠিক ঠিক মানা হচ্ছে না, পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণি ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে, পরাজিত হচ্ছে।

কথাটা সত্য। দুনিয়া জুড়েই সত্য। এক দিকে মজুরি, অন্য দিকে মুনাফা দাঁড়িপাল্লা উত্তরোত্তর আরও আরও ঝুঁকে পড়ছে। সত্তরের দশকের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পবাণিজ্যের আয়ে মুনাফার অনুপাত বাড়ছে, মজুরির ভাগ কমছে। ‘অকুপাই ওয়ল স্ট্রিট’ আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক নির্ঘোষ মনে পড়বেই: সব-পেয়েছি ১ শতাংশ বনাম সর্বহারা ৯৯। শ্রমিক শ্রেণির পিছিয়ে পড়ার, হেরে যাওয়ার সমস্যা ওঁদেরও, আমাদেরও। টুনির ঘরে যে রোগ আছে, রাজার ঘরেও সে রোগ আছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) এই সমস্যার কথা জোর দিয়ে বলবে এবং তার জন্য যুগপৎ কংগ্রেস ও বিজেপিকে দায়ী করবে, স্বাভাবিক।

কিন্তু তার পর? পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণি ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে গেছে, এটাই যদি নির্মম সত্য হয়, সেই সত্যের মোকাবিলায় পার্টি শ্রমিক শ্রেণির ভ্যানগার্ড পার্টি কী করতে চায়? ইস্তাহার জানাচ্ছে, ‘শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, জীবিকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষা’ই পার্টির মূল লক্ষ্য। উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ। কিন্তু উপায়? কয়েকটি নমুনা দেওয়া যাক: যথাযথ হারে ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় সমস্ত আইনি ব্যবস্থার সুষ্ঠু রূপায়ণ, চুক্তিবদ্ধ ও ঠিকা শ্রমিকদের সমস্ত আইনি সুযোগসুবিধার বন্দোবস্ত, এমনকী একই কাজের জন্য ঠিকা শ্রমিকরা যাতে স্থায়ী শ্রমিকের সমান বেতন পান তার আয়োজন, পুরুষ ও মহিলা কর্মীদের সমান কাজের জন্য সমান পাওনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। পড়তে ভারী ভাল লাগে, লক্ষ্মীর পাঁচালী শুনলে যেমন আজও মনটা প্রসন্ন হয়ে ওঠে, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি তো!

তবু জানতে ইচ্ছে করে, কী ভাবে হবে এ-সব? কে করবে? কমরেডগণ নিশ্চই জবাব দেবেন, নির্বাচনী ইস্তাহার তো দলের প্রস্তাবিত কর্মসূচি, শাসনক্ষমতার দাবিতে যা প্রচারিত হয়, সেই ক্ষমতা নাগালে এলে তবেই না রূপায়ণের কথা উঠবে। তা-ই যদি হয়, তবে আপাতত ঘুমিয়ে পড়াই বিধেয়, কারণ ভোটের অঙ্ক যা-ই দাঁড়াক, প্রকাশ কারাট এবং সম্প্রদায় নতুন সরকারের লাগাম হাতে পাবেন, এমনটা তো ম্যাজিক ছাড়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না, পি সি সরকার জুনিয়রও আবার এই বাজারে ওরা-র দলে।

বেয়াড়া মন নাছোড় প্রশ্ন তোলে, কিন্তু এ তল্লাটেই বাবুমশাইরা তো অনেক কাল গদিয়ান ছিলেন, তখন কী করলেন? হ্যাঁ, উত্তরটাও জানি, পাঁচালীতেই শুনেছি। ‘সীমিত ক্ষমতা’। তা বেশ তো, সীমিত ক্ষমতায় না-হয় সীমিত কাজই হোক, সে-ই বা কোথায়? ইস্তাহার উবাচ: কেরলে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় বামপন্থীদের বিকল্প নীতির কিছু রূপায়ণ দেখা গেছে, তার মধ্যে ‘কৃষক ও শ্রমিকদের জীবিকার সুরক্ষা’ও আছে। কেরল ও ত্রিপুরা যথাস্থানে থাকুক, পশ্চিমবঙ্গে শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা যদি বামফ্রন্ট করে থাকে, তবে সে ব্যবস্থা তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গোপন রাখতে পেরেছে, ডানলপ থেকে কানোরিয়া কোথাও কেউ টেরটি পায়নি।

ফাটা রেকর্ড বন্ধ করে সোজা কথাটা সোজাসুজি স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি বলতে পার্টির কর্তারা যা বুঝতেন, তার ধার এবং ভার দুইই গেছে, ভূত পিষে আর এক ফোঁটা তেলও বেরোবে না। অসংগঠিত শিল্প, ঠিকা শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আউটসোর্সিং-এর এই পৃথিবীতে ‘জোট বাঁধো তৈরি হও’ বলে চিৎকার করলে সিধে হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি ফিরে আসবে। সেটা ওঁরা মনে মনে জানেন নির্ঘাত। তিন দশকের বামপন্থী শাসনে ট্রেড ইউনিয়ন নামক বস্তুটি দেখতে দেখতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল, সেই শাসন যখন রাতারাতি বেবাক শেষ হয়ে গেল, তখনও তার চিহ্নমাত্র দেখা গেল না, রাতারাতিই অটো রিকশার কানে গোঁজা পতাকার নকশা উল্টে গেল পার্টি এর মানে বোঝেনি, তা তো হতে পারে না। অর্থনীতি পালটে যাচ্ছে, পুঁজি ও শ্রমিকের সম্পর্ক পালটে যাচ্ছে, অথচ শ্রমিক সংগঠন সেই পুরনো স্লোগান আঁকড়ে পড়ে থাকবে এবং প্রতিনিয়ত নানা রকমের ছোট ছোট ঘাঁটি আগলে রাখার হিসেব কষতে কষতে পার্টিকে মহাকরণে টিকিয়ে রাখার একাগ্র সাধনায় ভোটের রাজনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে চলবে এই কেরানিপনার পরিণাম অনিবার্য ছিল। কিন্তু ভাবনার কাঠামোয় ঘুণ ধরে গেলে এমনই তো হয়। কী মস্কো, কী কলকাতা দুনিয়ার ঘুণপোকার এক স্বভাব। তবে হ্যাঁ, এক দিক থেকে কলকাতার কমরেডদের সুবিধে আছে, বিজেপি’র আলোড়নে ভোটের জল ঘোলা হলে দু’চারটে মাছ আপনাআপনি এ-দিকে চলে আসতে পারে, মোদীজি ভরসা।

অথচ সর্বজ্ঞতার অহঙ্কার ছাড়তে পারলে নতুন করে ভাবার বিস্তর সুযোগ ছিল। চোরাবালিতে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে ‘শ্রমিকের সংগ্রাম চলছে চলবে’ বলে পাড়া মাথায় না করে নতুন অর্থনীতিতে ট্রেড ইউনিয়নকে নতুন করে গড়ে তোলা দরকার ছিল, যে ইউনিয়ন শ্রমিককে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তারের উপকরণ হিসেবে দেখবে না, তাকে সত্যিকারের সামর্থ্য দিতে চাইবে। সে জন্য শ্রমিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা, জীবনযাপনের সামাজিক পরিবেশ, সমস্ত বিষয়ে মন দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন ধরনের কাজের জায়গায় পরিস্থিতি অনুসারে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার উপায় খোঁজা জরুরি। সে জন্য কোথাও পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষির প্রয়োজন, কোথাও সহযোগিতার। আর, হ্যাঁ, ‘নেতারা সব জানেন, তাঁরাই সব ঠিক করে দেবেন’ এই প্রাচীন বিশ্বাস আঁকড়ে না থেকে সাধারণ শ্রমিকের কাছে পথের সন্ধান চাইতে হবে। সে জন্য অবশ্য সাধারণ শ্রমিককে সম্মান করা দরকার। আমাদের পার্টিনায়কদের ভাণ্ডারে সে বস্তুর প্রবল ঘাটতি। বছর সাত-আট আগে, তখনও ‘আমরা ২৩৫’-এর প্রবল দাপট, সিপিআইএমের এক প্রবীণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আর্জেন্টিনায়, লাতিন আমেরিকার আরও কোথাও কোথাও অনেক শিল্পসংস্থা পরিচালনার কাজ শ্রমিকরাই করছেন, দিব্যি করছেন, অন্তত এ রাজ্যের বন্ধ কারখানাগুলোতে তেমন একটা চেষ্টা করলেন না কেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ও-সব দেশে শ্রমিকরা যতটা সচেতন, এখানে তো এখনও তেমনটা নয়, ওই ভাবে তুলনা করা ঠিক হবে না।’ তিনি সৎ ভাবে মনের কথাই বলেছিলেন। মনটাই জুরাসিক যুগের। ওঁদের ট্রেড ইউনিয়ন সেই যুগেই পড়ে আছে। সেখান থেকে মুক্তি না পেলে তার মৃত্যু অবধারিত।

এবং, শ্রমিক আন্দোলনকে ট্রেড ইউনিয়নের পুরনো খোপের মধ্যে আটকে রাখলেও আর চলবে না। অনেক বড়, অনেক প্রসারিত সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তার সংযোগসাধন জরুরি। দেশ জুড়ে বিভিন্ন দাবিতে নানা ধরনের আন্দোলন চলছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের আন্দোলন, পাশাপাশি গড়ে তোলার আন্দোলন। শ্রমিক শ্রেণি পার্টির কেতাব থেকে পড়ে না, সমাজ থেকেই উঠে আসে, সমাজেই বাস করে। তার রাজনীতিকে বৃহত্তর সমাজের রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠতে হবে। বস্তুত, সেটাই সমকালের অর্থনীতির অলঙ্ঘ্য নির্দেশ। পুঁজি এখন সর্বগ্রাসী, সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে তার অপ্রতিরোধ্য প্রসার, আমাদের দৈনন্দিন আপাদমস্তক বাজারের দখলে। এই অর্থনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে চাইলে শ্রম আন্দোলনকেও সর্বত্রগামী হতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, শৌচাগার, পরিবেশ, সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকার, দৈনন্দিন নিরাপত্তা, বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপত্তা, জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে প্রত্যেকটি ঘাসের গোড়া অবধি বিস্তৃত ঠগবাজদের কারবার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার সামাজিক দায় এর প্রত্যেকটি কাজের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের গভীর যোগ থাকা জরুরি। একমাত্র সেই ভাবেই শ্রমিক রাজনীতি তার মরণান্তিক বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ধার পেতে পারে। কোথায় কী ভাবে সেই সংযোগ ঘটানো যায়, শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে কোন সামাজিক আন্দোলনের সম্পর্ক কেমন হবে, কোন উদ্যোগে শ্রমিক সংগঠন কী ভূমিকা নেবেন, সে-সবই খোলা প্রশ্ন, কারও কাছেই তার জানা-উত্তর নেই, উত্তর খুঁজতে হবে। কিন্তু সে জন্য সর্বাগ্রে ওই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতে হবে: আমরা জানি না।

জানি, অরণ্যে রোদন, কারণ পার্টি সব জানে। তবু, বচ্ছরকার দিনটা তো, এমন দুর্দশা দেখে একটু দুঃখ হয়। রাগও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho anirban chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE