Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বহুত্বের পথেই মোদী সফল হতে পারেন

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর নয়, বাস্তববাদী ভারতের দল হতে হবে বিজেপিকে। আডবাণী এক সময় চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। নরেন্দ্র মোদী পারবেন কি? তাঁর কিছু মন্তব্য আশা জাগায়। কিন্তু বক্তৃতা নয়, এখন কাজের পালা।অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কথাটাই একটু নিজের মতো করে ঘুরিয়ে বলছি। বর্তমান সময়টা অনেকটা অনর্গল কথা বলার মতো। ক্ষণে ক্ষণে তা অতীত হয়ে যায়। এই মুহূর্তটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে গেলে দেখি, যাঃ! সে তো অতীত হয়ে গিয়েছে। তাই বর্তমান কালটিকে বোঝার জন্যই অতীতকে জানার প্রয়োজন বেশি। অতীত নিছক অতীত নয়, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতের মুকুল।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কথাটাই একটু নিজের মতো করে ঘুরিয়ে বলছি। বর্তমান সময়টা অনেকটা অনর্গল কথা বলার মতো। ক্ষণে ক্ষণে তা অতীত হয়ে যায়। এই মুহূর্তটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে গেলে দেখি, যাঃ! সে তো অতীত হয়ে গিয়েছে। তাই বর্তমান কালটিকে বোঝার জন্যই অতীতকে জানার প্রয়োজন বেশি। অতীত নিছক অতীত নয়, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতের মুকুল। নরেন্দ্র মোদীর ন’মাসের ভারতের ভবিষ্যৎ তাই এই ন’মাসে যতটা না আছে, তার থেকে বেশি প্রোথিত ভারতবর্ষের অতীত ঐতিহ্যে।

সেই অতীত বহুত্ববাদের। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের। সম্রাট অশোক থেকে সম্রাট আকবরের। এবং ১৯৪৭ সালের পরেও সেই ধারা সচল থেকেছে। আবার বহুত্বের পাশাপাশি ভারতে সংঘাতের ইতিহাসও অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত বিষয়ক ইতিহাসবিদদের এক গোষ্ঠীর প্রচারিত তত্ত্বে বলা হয়, ভারতে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির জন্য শুধু ব্রিটিশ বিভাজনের শাসননীতি দায়ী নয়, সাম্প্রদায়িকতার বীজ সমাজের মধ্যেও ছিল। ব্রিটিশরা প্রশাসনের সুবিধার জন্য এই সমাজবাস্তবেরই সুযোগ নিয়েছিলেন। এই তাত্ত্বিকরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতা, জাতিভেদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব খুঁজে পান। এ নিয়ে বিস্তর তর্ক, কিন্তু ভারতীয় বহুত্ববাদের ভিতরকার অভ্যন্তরীণ সংঘাত যাই থাক, সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র যে ছিল, সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বস্তুত, এই প্রসঙ্গেই খেয়াল করা দরকার যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও বিতর্ক অনেক। অনেকেই মনে করেন, পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা আসার আগেই ভারতের সমাজে নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ছিল, সেই ঐতিহ্যই রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’-এর অন্তর্নিহিত শক্তি। এটা যতটা ধর্মের ব্যাপার, তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনধারার। আশিস নন্দী ও টি এন মদনরা বলবেন, পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতা এ দেশে এক বিদেশি ধারণা যা ভারতীয় সমাজে মিশে যেতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বহুত্ববাদের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি? সঙ্ঘ পরিবারের ঘোষিত লক্ষ্য এ দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। এ হল সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘোষণা। ভারতীয় রাষ্ট্র-সরকার-সমাজকে ভারতীয় না বলে হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা মানে দেশের নানা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করা। এই প্রেক্ষিতেই নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এই দৃষ্টিভঙ্গির গ্রাস থেকে বিজেপি এবং তার সরকারকে তিনি মুক্ত করতে পারবেন কি? বহুত্ববাদের অতীতকে ভবিষ্যতের পাথেয় করতে পারবেন কি? প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দিল্লির এক অনুষ্ঠানে খ্রিস্টধর্মীয় প্রতিনিধিদের সামনে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা তুলে ধরে এই বহুত্ববাদের প্রতি তাঁর আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। ঘোষণা করেছেন: ধর্মীয় হিংসা বরদাস্ত করব না। গুরুত্বপূর্ণ তাঁর এই ঘোষণা। কিন্তু এখন শুধু বক্তৃতা নয়, শাসক দল এই ভাবনাকে কতটা বাস্তবায়িত করবে, সেটাই হচ্ছে বিচার্য বিষয়।

এই প্রশ্নটা বিজেপিকে অতীতেও ভুগিয়েছে। লালকৃষ্ণ আডবাণীর সেই ঐতিহাসিক পাকিস্তান সফরে সঙ্গী ছিলাম। আডবাণী জিন্নার সমাধিক্ষেত্রে গিয়ে বলেছিলেন, দেশ ভাগের পর জিন্না ধর্মনিরপেক্ষ হলেও পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারেনি। আডবাণীর সেই মন্তব্যকে ঘিরে ভয়াবহ বিতর্ক হয় আর তার রাজনৈতিক মূল্য আডবাণীকে চোকাতে হয়েছিল ইস্তফা দিয়ে। তখন আডবাণী বলেছিলেন যে তিনি বিজেপির সংস্কার সাধন করতে চাইছেন, এই সংস্কার বিজেপির পক্ষে জরুরি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর নয়, বাস্তববাদী ভারতের দল হতে হবে বিজেপিকে। যেমন অ-সংসদীয় বিপ্লবের পথকে বর্জন করে সিপিএম সংসদীয় পথে এসেছে, যেমন নেপালে প্রচণ্ড এ কাজ করেছেন, সে ভাবেই বিজেপিকে উগ্র হিন্দুয়ানা থেকে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ পথে নিয়ে যেতে উদ্যত হন আডবাণী। পারেননি।

নরেন্দ্র মোদী পারবেন কি? ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রশাসনিকতার স্থায়িত্ব প্রতিষ্টার জন্য কি নরেন্দ্র মোদীকেও এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে হবে? অতীতকে ভুললে তিনি ভুল করবেন। সে অতীত পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০, এই সময়ে ভারতের সংবিধান রচনা হয়। আধুনিক ভারতের খসড়া তৈরি হয়। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭, জরুরি অবস্থা ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই কাঠামোর ওপর তীব্র আঘাত হানে। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে দেখা যায় জোট রাজনীতি, মণ্ডল রাজনীতি ও সামাজিক নায্যতার দাবি, ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে আর্থিক উদারবাদের যাত্রা, কিন্তু ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ভাঙন আবার ভারতীয় গণতন্ত্রের কাঠামোয় তীব্র কুঠারাঘাত। এই পরীক্ষানিরীক্ষা করতে করতে আমরা আজ ২০১৫ সালের চৌকাঠে। মোদীর সরকারকেও ভারতের গণতন্ত্রের এই বহুত্ববাদী ব্যক্তিস্বাধীনতার কাঠামোকে বাঁচিয়ে রেখেই এগোতে হবে। তা না করে আধুনিক বিজেপির নির্মাণের বদলে সঙ্ঘের চাপে বিজেপি যদি পিছন দিকে হেঁটে স্লোগান তোলে: ব্যাক টু দ্য বেসিকস, তা হলে ভারতীয় গণতন্ত্রই আবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

সেটা উদার অর্থনীতির পক্ষেও অনুকূল হবে না। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি ভারতের গয়ংগচ্ছ ধারাবাহিকতায় আসবে এক বৈপ্লবিক নয়া মোড়? কিছু অর্থনীতিবিদ তো ভোটের আগে থাকতেই বলতে শুরু করেছিলেন, কংগ্রেস-মুক্ত ভারতে এক নয়া দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদী বিজেপিকে দেখা যাবে। ভর্তুকির সংস্কৃতির অবসান হবে। বৃদ্ধির ইঞ্জিন দেশে উন্নয়ন ও আর্থিক সাফল্য আনবে। এবং সেই বলিষ্ঠ সংস্কারের মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িকতা বা হিন্দুত্ববাদের পশ্চাৎমুখী রাজনীতির অবসান ঘটবে। আর তাই মোদীর সরকার যখন বিলগ্নিকরণ ও অন্যান্য আর্থিক সংস্কারের রথ চালাতে চান, ঠিক তখনই নানা গির্জাঘরে আক্রমণ, সাধ্বী সাংসদের বিবৃতি দিয়ে ‘রামজাদে’ ও ‘হারামজাদে’র মতো কটূক্তি, হিন্দু সম্প্রদায়ের সন্তান সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য ইত্যাদি ইত্যাদি নানা বিবৃতির মিছিল মোদীর এই উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এখানে আর একটা বড় প্রশ্ন আছে। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর বিজেপি কী করতে চাইছেন? এক দিকে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বিক্রি করা যার মাধ্যমে এক নতুন রাষ্ট্রীয় আধিপত্য তৈরি হয়, অন্য দিকে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রধান চালিকাশক্তি করা? তা হলে সমস্যা আছে। সংস্কার ও উদার আর্থিক নীতি বাজার ও বেসরকারিকরণের বদ্ধ দুয়ারগুলি আরও বেশি বেশি করে খুলবে, কিন্তু তাতে তো রাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব হয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী পুঁজিবাদের বিকাশ হওয়ার কথা। তা হলে মোদীর আর্থিক সংস্কার ও সঙ্ঘ পরিবারের শক্তিশালী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে কি বিরোধ নেই?

বহুত্ববাদের আর একটা মাত্রা আছে, সেটাও মনে রাখা দরকার। ভারতীয় গণতন্ত্র এবং ভারতীয় অর্থনীতি, দুইয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সাফল্যের উপর। বিভিন্ন রাজ্য এবং অঞ্চলের মধ্যে আর্থিক অসাম্যর শিকড় বহু যুগ ধরে বিস্তৃত। শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের নামে এই আঞ্চলিক বৈষম্য যদি বাড়তে থাকে, তা হলে কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতও বাড়বে। বিরোধী আঞ্চলিক দলের নেতার পারিবারিক বিবাহে প্রধানমন্ত্রীর অংশ নেওয়া সুসমাচার। কিন্তু এই সামাজিক শিষ্টাচারে আর্থিক বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার জন্য প্রয়োজন আন্তরিক রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। বহুত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রচেষ্টা।

ভরসা একটাই। এ দেশে গণতন্ত্রের শক্তির একটা নিজস্ব চাপ রয়েছে। তাই মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ন’মাসের মধ্যে দিল্লিতে কেজরীবাল মুখ্যমন্ত্রী হন। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghosal anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE