কোনও সুদূর অতীতের কথা নয়। ২০০৭ সালের এই রকম সময়েই গোটা কলকাতা শহর ছেয়ে গিয়েছিল পুত্রহারা এক মায়ের আর্তি ‘মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে’ লেখা হোর্ডিংয়ে। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় মোমবাতি-হাতে নেমেছিলেন রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিচার চেয়ে। সারা ভারতের মিডিয়ার আলো পড়েছিল ঘটনাটির অস্বাভাবিকতার উপর। সাত বছর হয়ে গেছে, বিচার দূর অস্ত্।
একটি দু’টি ঘটনা নয়, আমাদের প্রত্যেকের চার পাশে বিলম্বিত বিচারের এমন অজস্র অভিজ্ঞতা। এক বার যদি কোনও কারণে আইনের দ্বারস্থ হতে হয়, তা হলে আর জীবদ্দশায় সেখান থেকে বেরোতে পারব কি না, জানি না। বিচারব্যবস্থার মাথা যাঁরা, তাঁরাও মাঝে মাঝেই এই দীর্ঘসূত্রী ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কয়েক মাস আগে ভারতের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি একটি সাক্ষাত্কারে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উচ্চ ন্যায়ালয়ে বিচারকদের ছুটি কমিয়ে দেওয়া হোক এবং ৩৬৫ দিনই কোর্ট খোলা থাকুক। বছরের গোড়ায় হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা যদি জানিয়ে দেন, তাঁরা কে কবে ছুটি চান, তা হলে সেই অনুসারে একটি তালিকা প্রস্তুত করা যেতেই পারে। একসঙ্গে সকলের ছুটি হওয়ার প্রথাটি বাতিল করলে, জমে থাকা মামলার বোঝা কমবে।
সঙ্গত ভাবেই এই প্রস্তাব নিয়ে নানা মন্তব্যের ঝড় উঠেছিল। ছুটি বাতিল এবং ৩৬৫ দিন কোর্ট খোলা রাখাটাই একমাত্র পথ কি না, এবং এই পথ-প্রদর্শন মূল সমস্যার অতি-সরলীকরণ কি না—তর্ক হয়েছিল। কিন্তু মামলার পাহাড় কী ভাবে কমানো যাবে, তার সদুত্তর মেলেনি।
জাস্টিস রবীন্দ্র ভট্ট কমিটির (২০১৩) রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেওয়ানি মামলা মিটতে গড়ে পনেরো বছর সময় লাগে। এই কমিটির হিসেব অনুসারে জনসংখ্যার অনুপাতে মামলা দায়ের হওয়ার মাত্রা আগামী তিন দশকে পাঁচগুণ হবে। বস্তুত, এই হিসেব মনে রেখেই বিচারব্যবস্থাকে সাজানো উচিত। অথচ মামলার পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, বিচারপতির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে তার অর্ধেক হারে। ফলে, বিচারপতিদের কাজের চাপ বেড়েই চলেছে। এক দিনে দুই বা তিন বিচারপতির বেঞ্চ গড়ে পঞ্চাশ থেকে সত্তরটি মামলা শোনেন। এই সব মামলার কাগজপত্র পড়াও একটা বিরাট কাজ। দেশের একুশটি হাইকোর্টের ৯০৬টি অনুমোদিত পদের তিনশোটিতে কোনও বিচারপতি নেই। জেলার ও নিচু তলার কোর্টে ৩,৩০০ পদ খালি।
প্রসঙ্গত, অন্য নানা দেশের চিত্রটা এতটা হতাশাব্যঞ্জক নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে কাজের দিন ১৯৩, হাইকোর্টে ২১০ দিন এবং ট্রায়াল কোর্টে ২৪৫ দিন। বাকি ছুটি। কানাডায় আদালত ছুটি থাকে ১১ দিন, সিঙ্গাপুরে ৫৫, বাংলাদেশেও। বিচারপতির সংখ্যাতেও ফারাক বিস্তর। ভারতে যখন ১৯ হাজার বিচারপতি আছেন, চিনে আছেন ১ লক্ষ ৯০ হাজার। ফলও তথা এব চ। ভারতে দেওয়ানি মামলা মিটতে গড়ে সময় লাগে পনেরো বছর, চিনে তিন মাস।
যথেষ্টসংখ্যক বিচারক না থাকা যে বিচারপদ্ধতির দীর্ঘসূত্রিতার একটা কারণ, কিছু দিন আগে এক একান্ত কথোপকথনে মাননীয় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় এবং মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় দুজনেই তা মেনে নিলেন। তবে মামলা চলার গোটা পদ্ধতিটাই যে সময়সাপেক্ষ, তা মেনে নেওয়ার পরেও শ্রীমুখোপাধ্যায় বলেন যে, কিছু কিছু পর্যায়ে খানিকটা ইচ্ছাকৃত সময় নষ্ট হয়। যেমন, উকিলরা যত বার তারিখ নেন, তত বার ‘ফিস’ পান। ফলে, তাঁদের একাংশ মামলায় তারিখ নেওয়াটাই সুবিধাজনক বলে মনে করেন। আবার, মামলায় যে পক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে, তার পক্ষেও মামলা টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা স্বার্থ কাজ করে। তা ছাড়াও নিচু তলায় মামলা দিনের দিন শুনানি হয় না। লিস্টে মামলা তোলা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ‘আইন নিজের পথে চলবে, এ কথাটার কোনও অর্থ হয় না। যেমন ভাবে চালাবে, তেমন ভাবে চলবে।’ জোরের সঙ্গে বলেন শ্রীমুখোপাধ্যায়। ফৌজদারি মামলায় আবার খুব বেশি নির্ভর করতে হয় পুলিশের ওপর। যদি তদন্ত করার ব্যাপারটা ‘ইনভেস্টিগেশন সেল’ তৈরি করে তার উপর ছাড়া হয়, তা হলে পুলিশের পক্ষেও সুবিধা হয়, তার তদন্ত প্রক্রিয়াটিও দ্রুত হয়।
মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমেই দায়ী করেন সরকারি মনোভাবকে। বিচারব্যবস্থার জন্য এক শতাংশেরও কম টাকা ধার্য করা হয় বাত্সরিক বাজেটে।
কেবল টাকা কম ধার্য করা নয়, ‘দিনের পর দিন সরকার নতুন আইন করছে, অথচ কোর্ট তৈরি করছে না।’
২০০৮ সালে আইন সংক্রান্ত একটি পত্রিকায় তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মাননীয় অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় বিচারব্যবস্থার সংস্কার (জুডিশিয়াল রিফর্মস) বিষয়ে একটি নিবন্ধ রচনা করেন। সেখানে তিনি কিছু পরামর্শ দেন, যা মান্য করা হলে জমে থাকা মামলার বোঝা কিছুটা হলেও কমবে। ভারতীয় ল’ কমিশন-এর ২০০৯-এর রিপোর্ট সেই পরামর্শকে মান্যতা দেয় এবং বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে। কিন্তু, একটি পরামর্শও মানা হয়নি। পরামর্শগুলি সংক্ষেপে এই রকম:
১) আদালতের কাজের সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার আবশ্যিক করা উচিত, বিচারপতিদের সময়ানুবর্তী হওয়া উচিত এবং আইনজীবীদের একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত মুলতুবি চাওয়া উচিত নয়। ‘সিভিল প্রসিডিওর কোড’-এর ১৭নং ধারার দ্বারা ‘মুলতুবি’ কঠোর ভাবে চালিত হওয়া উচিত।
২) একই বিষয়ের উপর বহু মামলা রুজু করা হয়, সে ক্ষেত্রে একটি রায়ই বহু মামলার নিষ্পত্তি করতে পারে। কারিগরি প্রযুক্তির সাহায্যে এই মামলাগুলি একত্রিত করে গুরুত্ব অনুসারে নিষ্পত্তি করা উচিত। এর ফলে পড়ে থাকা মামলার সংখ্যা অনেক কমে যাবে। একই ভাবে, পুরনো ফলাফলহীন মামলাগুলির একটা তালিকা প্রস্তুত করে শুনানির ব্যবস্থা করলে সেগুলি নিষ্পত্তির জন্য বেশি সময় লাগবে না। মূল মামলা মিটে গেলেও, অন্তর্বর্তিকালীন সময় চেয়ে দরখাস্ত করা হয়েছে, এমন সব ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।
৩) বিচারপতিদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর রায় দান করা উচিত। এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি, উভয় ধরনের মামলার ক্ষেত্রেই অনিল রায় বনাম স্টেট অব বিহার (২০০১) সেকশন ৩১৮ মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মানা উচিত।
৪) পড়ে থাকা মামলাগুলির নিষ্পত্তির জন্য উচ্চতর আদালতের ছুটি দশ থেকে পনেরো দিন কমানো উচিত এবং আদালতের দৈনিক কাজের সময় অন্তত আধ ঘণ্টা বাড়ানো উচিত।
৫) আইনজীবীদের একঘেয়ে এবং পুনরুক্তিমূলক সওয়াল কমিয়ে লিখিত বক্তব্যের দ্বারা পরিপূরণ করা উচিত, যদি না মামলাটিতে আইনের জটিল প্রশ্ন বা সংবিধানের ব্যাখ্যার প্রশ্ন জড়িত থাকে। মৌখিক সওয়ালের দৈর্ঘ্য দেড় ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিত নয়।
৬) আদালতের রায় স্বচ্ছ, নিশ্চিত এবং দ্ব্যর্থহীন হওয়া উচিত, যাতে পুনরায় মামলা করার আশঙ্কা না থাকে।
৭) আইনজীবীদের কোনও ভাবেই ধর্মঘটের আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে হরিশ উপ্পল (প্রাক্তন ক্যাপ্টেন) বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) সেকশন ৪৫ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ‘সাংবিধানিক বেঞ্চ’-এর নির্দেশ অনুসরণ করা উচিত।
এই সব সংস্কার প্রস্তাবের পরও থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। সে প্রশ্ন আইনের সামাজিক পরিচয় এবং কার্যকারিতার প্রশ্ন। আদালতেরও উপরে আছে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন। সামাজিক ন্যায়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলেই প্রত্যেক পদে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে আদালতে। ‘আর কোথাও যাবার জায়গা নেই’, মন্তব্য করেন শ্রীগঙ্গোপাধ্যায়। ‘এ কথা ঠিক যে, আইন বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের পথও বঙ্কিম’, মনে করেন তিনি। একই আক্ষেপ শ্রীমুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে: ‘পুরনো মূল্যবোধ চলে গেছে। নতুন মূল্যবোধ তৈরি হয়নি। সবটাই কেমন যেন টাকা আর শারীরিক বলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।’
আইন-আদালত যে শেষ কথা নয়, এ তো আমাদের জানাই আছে। তবু নিরুপায় নাগরিকের যখন আইনের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই, তখন সেই ব্যবস্থাটাকে ঠিক মতো কাজ করতে দেওয়ার প্রশ্নে কোনও আপস চলে না এ কথা রাষ্ট্রকেও মানতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy