Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মৌলবাদের অভিযান

কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ককে তাঁহার দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগান ধাপে ধাপে অটোমান সুলতানদের সাবেক তুরস্কের অভিমুখে টানিয়া চলিয়াছেন। গণতন্ত্র নয়, ইসলামই ক্রমশ তাঁহার রাষ্ট্রনীতির মানদণ্ড হইয়া উঠিতেছে।

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ককে তাঁহার দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগান ধাপে ধাপে অটোমান সুলতানদের সাবেক তুরস্কের অভিমুখে টানিয়া চলিয়াছেন। গণতন্ত্র নয়, ইসলামই ক্রমশ তাঁহার রাষ্ট্রনীতির মানদণ্ড হইয়া উঠিতেছে। সম্প্রতি রাজধানী ইস্তানবুলে এক আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে তাঁহার অমৃতভাষণ শোনা গিয়াছে: নারীরা কোনও মতেই পুরুষের সমান হইতে পারে না, কেননা এই সাম্যের ধারণাটিই প্রকৃতিবিরুদ্ধ। সংসারে নারীর কাজটিও অনন্য: মাতৃত্ব। কেননা ইসলাম তাহাই নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। নারীবাদীরা এই সত্যটি মোটে বুঝিতে চাহে না। তাহারা মানবস্বভাবের বিপরীতে গিয়া নারীপুরুষের সাম্য দাবি করে, ইত্যাদি। এমন সুভাষিত এরদোগান এই প্রথম বিতরণ করিতেছেন, এমন নয়। ইতিপূর্বে তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণকে ‘হত্যা’ আখ্যা দিয়াছেন, গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়া ও গর্ভপাত করানোকে ‘পাপ’, এবং প্রতিটি তুর্কি নারীর অন্তত তিনটি করিয়া সন্তানের জননী হওয়ার সুপরামর্শ দিয়াছেন। হ্যঁা, একবিংশ শতক চলিতেছে।

তুরস্কের মহিলারা বিনা প্রতিবাদে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য মানিয়া লন নাই। ভৌগোলিক ভাবে ইউরোপ হইতে বসফরাস প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং ঐতিহাসিক ভাবে চারশো বছর অটোমান মুসলিম শাসনে থাকিলেও তুরস্ক ইউরোপের সংলগ্নও। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য তুরস্কবাসীর এক বড় অংশের আকুতিও প্রবল। কিন্তু আতাতুর্কের তুরস্ক উত্তরোত্তর মধ্যযুগীয় অসাম্য ও বৈষম্যের অন্ধকারে চলিয়াছে। এ ব্যাপারে প্রধান পুরোহিতের কাজটি করিতেছেন এরদোগান, যিনি জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির রাজনীতিক হিসাবে প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্বে আসীন হইলেও রাশিয়ার অনুকরণে সংবিধান সংশোধন করিয়া নিজেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করিয়া লইয়াছেন এবং অতঃপর দফায় দফায় সেই শীর্ষ পদে বহাল থাকার অভিপ্রায়ও গোপন করিতেছেন না। ২০০৩ সাল হইতে তিনি ক্ষমতাসীন। আতাতুর্কের তুরস্ককে তিনি কালক্রমে শরিয়ত-শাসিত তুরস্কে রূপান্তরিত করিবেন কি না, তাহা এখনই স্পষ্ট নয়। তবে মহিলাদের সম্পর্কে তাঁহার ইসলামি ধ্যানধারণাগুলি দেশকে সেই রক্ষণশীলতার দিকেই টানিতেছে। আতাতুর্ক প্রকাশ্যে ধর্মাচরণের উপর যে সব নিষেধাজ্ঞা বলবত্‌ করিয়াছিলেন, সে সবই প্রত্যাহৃত। বোরখা আবার ইস্তানবুলের রাস্তায় ঘুরিতেছে, মহিলারা ক্রমেই হিজাবের আড়ালে আত্মগোপনে প্ররোচিত হইতেছেন। ইহা তাত্‌পর্যপূর্ণ যে, লিঙ্গবৈষম্য অনুশীলনে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে তুরস্ক নামিয়া আসিয়াছে ১২০তে। আর পরিবারের ভিতরে মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনাও ইউরোপের তুলনায় তুরস্কে ১০ গুণ বেশি।

এরদোগান যে নিজেকে অটোমান সুলতানদের মতোই গণ্য করিতেছেন, তাহার সর্বশেষ প্রমাণ দেশের আইনকানুন সম্পর্কে তাঁহার শ্রদ্ধাহীনতা। তাঁহার সরকারি নীতি আদালতের রায়ে ভর্ত্‌সিত হইলে তিনি বলিতেছেন, আইন অপেক্ষা ন্যায়দর্শী সুলতান অনেক বড়। অনুমান করা যায়, এই দেশে মহিলাদের সাম্য অর্জন ক্রমশ অসম্ভব হইয়া উঠিবে। আশঙ্কা হয়, তাঁহাদের গতিবিধির উপর দিন দিন আরও কড়াকড়ি আরোপিত হইবে, তাঁহাদের স্বাধিকারপ্রমত্ততার উপর নজরদারি বাড়িয়া চলিবে। ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়াছে, মৌলবাদী শাসনের পথে যাত্রা শুরু হইলে সর্বাগ্রে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়ন নামিয়া আসে মেয়েদের উপর। এরদোগানের তুরস্ক ব্যতিক্রম হইবে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE