Advertisement
০২ মে ২০২৪

রাজ্যের মানুষের মনে মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে

এই জনসমাজ আবার পরিবর্তনের ডাক দিয়ে বিজেপিকে কি গ্রহণ করতে প্রস্তুত? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালসে দিন এনডিটিভি-র এক আলোচনায় তৃণমূল মুখপাত্র রাজ্যসভার সদস্য ডেরেক ও’ব্রায়েন কিছুতেই মানতে রাজি নন যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্পর্কে আশাভঙ্গের এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা এবং রাজ্যসভা সদস্য চন্দন মিত্র আর ডেরেকের তুমুল বাগযুদ্ধ। চন্দনের দৃঢ় প্রত্যয়, ২০১৬ সালে মমতা সরকারকে বদলে বিজেপি সরকারকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সে দিন এনডিটিভি-র এক আলোচনায় তৃণমূল মুখপাত্র রাজ্যসভার সদস্য ডেরেক ও’ব্রায়েন কিছুতেই মানতে রাজি নন যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্পর্কে আশাভঙ্গের এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা এবং রাজ্যসভা সদস্য চন্দন মিত্র আর ডেরেকের তুমুল বাগযুদ্ধ। চন্দনের দৃঢ় প্রত্যয়, ২০১৬ সালে মমতা সরকারকে বদলে বিজেপি সরকারকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

এ এক মহা সমস্যা! ভারতের রাজনীতিকেরা ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ রাজনীতিতে এত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন যে সেখানে যুক্তির মহাপ্রস্থান হয়। অনেক কষ্ট করে সেই প্রবল ধোঁয়ার মধ্যে নিজের কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। সে বক্তব্য সাদা এবং কালোর মাঝখানে ধূসর।

পশ্চিমবঙ্গের সমাজতত্ত্ব যথেষ্ট জটিল ও বিচিত্র। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশের প্রথম স্তরে পশ্চিমী শাসনের বিপুল প্রভাব অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিজাত মূল্যবোধ ছিল বাংলার সাংস্কৃতিক মানদণ্ড। পরে রদ হলেও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিপুল প্রভাব ফেলে। তার পর ১৯৪৭ সালের দেশভাগে পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি আর যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতিতে কোনও সাহায্য করেনি।

পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল কলকাতার অভিজাততন্ত্রের গ্রামকরণ (ruralisa-tion) হল। অধ্যাপক মাইরন ওয়েনার (Myron Weiner) নাম দেন, ‘রুরালাইজেশন অফ এলিটস’। এর ফলে শহর থেকে গ্রামের আনুপাতিক বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। গ্রাম ও শহরের মধ্যে সংঘাতও পশ্চিমবঙ্গে খুব তীব্র। ’৬২ সালের নির্বাচনের পর থেকেই দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ বাংলার উপর কলকাতার রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ অনেক কম। বিধানসভার প্রার্থীদের জাতি ও শহর গ্রামের ভেদাভেদ পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, শহরের চেয়ে গ্রামের প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশি। এই যে কলকাতা পুরসভার অ্যাডেড এরিয়া বা অতিরিক্ত লোক বাড়ছে, তাতে গ্রামের রাজনৈতিক পরিসর কলকাতার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে বিশেষ ভাবে কাজ করবে। আর এক অধ্যাপক রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তিনটি আর্থিক শ্রেণিতে ভাগ করেন। প্রথম শ্রেণি হল জমিদার, যাঁরা চাষ করেন না। দ্বিতীয় শ্রেণি হল ‘সাব ইনফিউডেটরি ল্যান্ডলর্ড’, স্বাধীন চাষি, কারিগর, দোকানদার। মূলত জমিকে মূলধন করে এঁরা স্বাধীন জীবিকা নির্বাহ করেন। তৃতীয় শ্রেণি হল কৃষি শ্রমিক, ভাগচাষি, পরিষেবা প্রদানকারী।

প্রথম শ্রেণিতে রয়েছে উচ্চবর্ণের হিন্দু, দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং সৈয়দ মোসলেম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তফসিলি জাতি। এই নানা ধরনের শ্রেণি বিভাজনেও গ্রামীণ জনজীবন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এ আর দেশাই সম্পাদিত ‘রুরাল সোসিওলজি ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও মাইরন ওয়েনার-এর দু’টি প্রবন্ধ থেকে পশ্চিমবঙ্গের এই সমাজতত্ত্বের কথা বিশদে জানা যায়। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সমাজেও এই শ্রেণি বিভাজনের কঙ্কালটি থেকে গিয়েছে। তার মধ্যে এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন।

এই পটভূমির মধ্য দিয়ে বাংলা বিকশিত হয়েছে, বাঙালি নেতৃত্ব অতীতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায়, তার পর নেতাদের চরিত্রেও গ্রামীণ সংস্কৃতির আধিপত্য।

সিপিএম এই গ্রামীণ অনভিজাত সংস্কৃতির পরিসরেই রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করে তিন দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই রাজনৈতিক পরিসরটিকেও সাফল্যের সঙ্গে করায়ত্ত করেছেন।

মমতা তাঁর সৎ ভাবমূর্তি, আন্তরিক প্রচেষ্টা, কার্ল মার্কস যাকে বলেছিলেন ‘সিঙ্গলনেস অফ পারপাস’। সে অর্থে মমতা এক সফল বিরোধী নেত্রী। কিন্তু এখন মমতা এক অন্য ভূমিকায়। গত তিন বছর ধরে মমতা রাজ্যপাট চালিয়েছেন। এ কথা তো সকলকেই স্বীকার করতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে এক মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। জনমতের এই ‘অধোগতি’ প্রকৃতির সূত্র। সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা দখল করে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে মরিয়া বিজেপি। কংগ্রেস এবং সিপিএম— রাজনৈতিক পরিসর দখলের লড়াইয়ে সে ভাবে সফল হয়নি যে ভাবে বিজেপি হচ্ছে। তার মানে কিন্তু ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিজেপি বাংলার সিংহাসনে আসীন হবে এমন কথা সত্য নয়। নির্বাচনী ফলাফলের ভবিষ্যৎবাণী করাও আমার কাজ নয়। কিন্তু এ কথা বলতে পারি, বাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ যদি হিন্দু হয়, তবে তার সামাজিক ভিত্তিভূমিতে শহরের পাশাপাশি যে গ্রামীণ বর্ধিত জনসমাজ আছে (তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, নিম্নবর্গ) সেই বিপুল জনসমাজ যে মমতাকে পরিত্যাগ করেছে এমন বোধহয় নয়। কর্মসংস্থানের সঙ্কট, দারিদ্র্য, বেকারি, অনুন্নয়ন রাজ্যে নতুন নয়। কিন্তু সিপিএম থেকে তৃণমূলের এই পরিবর্তনে আখেরে কোনও লাভ হল না— এই মতামত কি এই জনসমাজে গড়ে উঠেছে? এই জনসমাজ আবার পরিবর্তনের ডাক দিয়ে এ বার বিজেপিকে কি গ্রহণ করতে প্রস্তুত? ব্রিটিশরা এশীয় সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনছিলেন, উৎপাদন ব্যবস্থার সে পরিবর্তনকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন ‘প্যাসিভ রেভলিউশন’। সেই নিঃশব্দ বিপ্লব কি আজও হয়ে চলেছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE