Advertisement
০৬ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

রাজনীতি তো শেষ কথা বলেই থাকে

নীতি আয়োগের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী যাননি, এটা নিশ্চয়ই রাজনৈতিক লড়াইয়ের একটা কৌশল। কিন্তু এতে রাজ্যের ক্ষতি হবে, এমনটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই।কিছু দিন আগে দিল্লিতে ‘নীতি’ (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া) আয়োগ নামক নতুন বৈঠকে রাজ্যের তরফে সদস্য অর্থাৎ মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অন্য সব রাজ্যের কর্ণধাররা ছিলেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে।

কেন্দ্রের দাপট কমবে? নীতি আয়োগের প্রথম বৈঠক। দিল্লি, ৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

কেন্দ্রের দাপট কমবে? নীতি আয়োগের প্রথম বৈঠক। দিল্লি, ৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

কিছু দিন আগে দিল্লিতে ‘নীতি’ (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া) আয়োগ নামক নতুন বৈঠকে রাজ্যের তরফে সদস্য অর্থাৎ মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অন্য সব রাজ্যের কর্ণধাররা ছিলেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের অনুপস্থিতি রাজ্যের স্বার্থ অনেকটা ক্ষুণ্ণ করবে, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের জন্য রাজ্যের স্বার্থ বিসর্জিত হবে, ইত্যাদি। এই লেখায় আমি মূলত দু’টি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমত, নীতি আয়োগের মধ্য দিয়ে কী ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হতে চলেছে। দ্বিতীয়ত, প্রথম বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধির উপস্থিত না হওয়ায় রাজ্যের অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত স্বার্থহানির সম্ভাবনা আছে কি না।

নীতি আয়োগে মুখ্যমন্ত্রীদের সদস্য করায় উন্নয়ন সম্পর্কিত জাতীয় পরিকল্পনায় আরও বিকেন্দ্রীকরণ ও কেন্দ্রীয় সাহায্য নির্ধারণ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে রাজ্য সরকারের যোগদান, এই দু’টি ব্যাপারে ঠিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে, এ বারে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন অর্থ কমিশনের উপদেশ মেনে রাজ্যগুলোকে মোট কর আদায়ের আরও বেশি অংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে এবং একই সঙ্গে রাজ্যগুলির জন্য যে সব কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাবদ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্তর থেকে টাকা আসে, সেগুলিকে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে রাজ্য স্তরে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারেরা এই প্রকল্পগুলি ঠিক মতো চালাতে না পারলে বা সেই বাবদ খরচ অন্য খাতে প্রবাহিত হলে ‘প্রকল্পগুলি ভাল চলছে না’ বলে কেন্দ্রকে দোষারোপ করতে পারবে না। রাজ্য সরকার করের বেশি অংশ আয় হিসেবে পাবে, সেই আয়কে ঠিক ভাবে কাজে লাগাতে হবে তাদেরই। এক অর্থে কেন্দ্রীয় সরকার রাজস্ব আয়ব্যয়ের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবে।

অতিরিক্ত আয়ের বণ্টন রাজ্যগুলির মধ্যে কী ভাবে হবে, কী নিয়মে হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে রাজনৈতিক চাপান-উতোরের পথ কিছুটা বন্ধ হতে পারে। অনেক সময় কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাবদ বরাদ্দ টাকা এক লপ্তে আসে না, কাজ অনুযায়ী ধাপে ধাপে আসে। দিল্লি থেকে টাকা আসতে দেরি হওয়ায় কাজ ব্যাহত হয়।

অন্য দিকে, অধিকাংশ প্রকল্পের ওপর রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ আখেরে সুফল দেবে কি না, তা রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও রাজনৈতিক উপাদান থাকে, আবার রাজ্যের ওপর চাপও থাকে টাকাপয়সা ঠিক ভাবে খরচ করার। ফলে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজ্যের স্তরে রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, সব মিলিয়েই এই সংস্কারের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। এক কথায়, রাজ্য সরকার দক্ষ এবং উন্নয়নমুখী হলে তার এতে সুবিধা হবে।

নীতি আয়োগের কার্যকলাপের সঙ্গে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং অংশীদারি গণতন্ত্রের একটা প্রলেপ লাগানো হচ্ছে। সেটা কেন্দ্রীয় স্তরে সামগ্রিক নীতি নির্ধারণে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। যোজনা কমিশনের তুলনায় এই আয়োগ অনেক বেশি রাজনীতিনির্ভর। যদিও পুরনো কমিশনের অরাজনৈতিক সদস্য নির্বাচনে রাজনীতির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, কিন্তু এখনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যের জন্য যোজনা ব্যয় বাড়াতে চাইবেন। মুখ্যমন্ত্রী সদস্যপদে বসুন বা না বসুন, রাজ্যের তৈরি যোজনার খসড়ায় পর্যাপ্ত অর্থের দাবি করাই হয়ে থাকে। বিগত যোজনা কমিশনের মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীরা তাঁদের দাবি পেশ করতেন। প্রত্যক্ষ সদস্যপদ নিঃসন্দেহে একটি উন্নততর ব্যবস্থার বার্তাবহ, কিন্তু কেন্দ্রের আপাত বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ক্ষমতা শেষ গানটি গাইবে বলেই মনে হয়। এটাও স্পষ্ট যে, প্রতিটি রাজ্যের অর্থ মন্ত্রকের গুরুত্ব বাড়বে, বাড়বে সরকারি দায়বদ্ধতা ও আমলাদের দায়িত্ব। পণ্য পরিষেবা কর ব্যবস্থা (জিএসটি) চালু হলে ২০১৬ থেকে পরিষেবা কর আদায়ের অধিকার পাবে রাজ্য সরকার, ফলে অর্থমন্ত্রকের কাজকর্ম আরও বাড়বে। আর্থিক ভাবে রাজ্যগুলি কিছুটা স্বনির্ভর হবে।

এ বার আসি প্রথম বৈঠকে রাজ্যের অনুপস্থিতি সম্পর্কে। কোনও মানুষের যে-কোনও সিদ্ধান্ত, সেই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ লাভক্ষতি দিয়ে নির্ধারিত। এই প্রসঙ্গে রাজ্যের লাভক্ষতির প্রসঙ্গ এসে পড়ছে। ব্যাপারটি তাই আর একটু গভীর ভাবে দেখা প্রয়োজন। নীতি আয়োগের অধুনা গঠিত সাব-কমিটিগুলি যে সিদ্ধান্তই নিক, সব রাজ্যের ক্ষেত্রে একই ভাবে সে নীতি প্রবর্তিত হবে। বেছে বেছে পশ্চিমবঙ্গকে ব্রাত্য করার অবকাশ নেই। সংস্কারের ফলে সব রাজ্য সুবিধা পাবে, এ রাজ্যও। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিপক্ষেও যাবে, স্বাভাবিক, কারণ গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া দুই সরকারে আসীন দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত আর কোথাও এতটা প্রবল নয়, তার উপর পশ্চিমবঙ্গে অদূরেই নির্বাচন। কিন্তু সে ধরনের সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী গেলেন কি গেলেন না, তার ওপর নির্ভর করে না। বরং সংস্কারের ফলে যদি অন্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সামগ্রিক রাজস্বের বৃহত্তর অংশ হস্তান্তরিত হয় ও কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির ওপর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ে, তা হলে কেন্দ্রের মন জুগিয়ে চলার দরকারও খানিকটা কমবে।

পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক বেগ দেওয়ার চেষ্টা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে বলেই আমার ধারণা। অর্থনীতির পরিভাষায় গেম থিয়োরিতে ‘বিশ্বাসযোগ্য ভয়’ (ক্রেডিবল থ্রেট) দেখানোর ভূমিকা অপরিসীম। যদি ভয় দেখানো বিশ্বাসযোগ্য না হয়, অর্থাৎ আমি যদি মনে করি, যে এখন ভয় দেখাচ্ছে, সে রকম পরিস্থিতিতে সে আসলে কিছুই করবে না— তা হলে আমি কেন ভয় পাব? পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক স্বার্থ কোনও কারণে ক্ষুণ্ণ হলে, আগামী নির্বাচনে শাসক দল তাকে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে পারে, আর যদি নীতি আয়োগের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী না গেলেও রাজ্য সামগ্রিক ভাবে সংস্কারের সমান ভাগীদার হয়, তা হলে সাদা রুমাল হাতে বৈঠকে গেলে বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চনার সম্ভাবনা বেশ কম। তা ছাড়া, একটা ব্যাপারও নিঃসন্দেহে উষ্মা জাগায়। যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে দেশের হয়তো বিরাট ক্ষতি কিছু হয়নি, নীতি আয়োগ ব্যাপারটিও মন্দ নয়, কিন্তু এত বড় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে গিয়ে যে বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া হয়নি, সেগুলিও চোখে পড়ার মতো:

ক) রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি, কোনও ধরনের ঐকমত্যের চেষ্টা হয়নি, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

খ) রাজ্য যোজনা পর্ষদের কাঠামোর সঙ্গে নীতি আয়োগের কাঠামোর সম্পর্কটা কী হবে? নীতি আয়োগের নির্ধারিত কার্যকলাপের পরিধি ও ব্যাপ্তি কী হবে?

গ) পাঁচসালা যোজনা কী ভাবে তৈরি হবে?

শেষে বলি, কেন্দ্রের শাসক দল রাজ্যের শাসক দলকে বিভিন্ন ভাবে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা জারি রেখেছেন। রাজনীতিতে সম্মুখ সংগ্রামের যে স্ট্র্যাটেজি, সেটা সব দলই সময় বুঝে গ্রহণ করবে। কারও কারও কাছে বোঝাপড়া সংগ্রামে আপসের শামিল। রাজনৈতিক ভাবে তুমুল জনপ্রিয় নেতারা রাজনীতির ময়দানে লড়াইয়ে নেমে কোনও বোঝাপড়ার বার্তা দিতে চাইবেন না, এটা হতেই পারে। আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর কোনও আপাতকুফল না থাকলে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটাই মূল হয়ে দাঁড়াবে। ভুললে চলবে না, কন্যাশ্রী প্রকল্প, ন্যায্য দামে ওষুধ, পঞ্চায়েত এবং পুরসভার বিভিন্ন প্রকল্প সরকারি ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বাহবা কুড়িয়েছে। ফলে ক্ষতির আশঙ্কা খানিকটা হলেও অমূলক। তাই রাজনীতি শেষ কথা বললে নতুন করে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sugata marjit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE