Advertisement
E-Paper

লঘু ও গুরু

গুরু ও শিষ্য এক দেশে আসিয়া দেখে, মুড়ি ও মিছরির দর সেই স্থানে সমান। শিষ্য নাচিয়া উঠিল, কিন্তু গুরু বলিলেন, এই মুহূর্তে পলাও, নহিলে বিপদে পড়িবে। যাহারা লঘু ও গুরুর পার্থক্য জানে না, তাহারা নির্বিচারে যুক্তি ছত্রখান করে। এই রাজ্যেও, লঘু ও গুরুর পার্থক্য ক্রমেই গুলাইয়া দেওয়া হইতেছে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০১

গুরু ও শিষ্য এক দেশে আসিয়া দেখে, মুড়ি ও মিছরির দর সেই স্থানে সমান। শিষ্য নাচিয়া উঠিল, কিন্তু গুরু বলিলেন, এই মুহূর্তে পলাও, নহিলে বিপদে পড়িবে। যাহারা লঘু ও গুরুর পার্থক্য জানে না, তাহারা নির্বিচারে যুক্তি ছত্রখান করে। এই রাজ্যেও, লঘু ও গুরুর পার্থক্য ক্রমেই গুলাইয়া দেওয়া হইতেছে। তাপস পালের যেমন, লঘু পাপে গুরু দণ্ড হইল। তাঁহাকে ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে হইল, তবে তিনি ছাড় পাইলেন। অথচ ইহার পূর্বে মনিরুল ইসলাম, অনুব্রত মণ্ডল তীব্র কুকথা বলিয়াছেন। তাঁহাদের নিন্দায় মুখরিত হইয়াছে গণমাধ্যম। তবু তো দলের পক্ষ হইতে তাঁহাদের এক বারের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া চিঠি দিতে বলা হয় নাই। তাঁহারা সকলেই বক্ষ ফুলাইয়া মহাসমারোহে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। তবে তাপস কী দোষ করিলেন? কিছু মানুষ তাপসের কথা শুনিয়া তাঁহার শাস্তির দাবিতে প্রচণ্ড হইহই পাকাইয়া তুলিয়াছেন ঠিকই, কিন্তু কর্মহীন জনতা কোন নূতন হুজুগ পাইয়া আলোড়িত হইয়া উঠিল, কিংবা ধূর্ত টিভি চ্যানেল কাহার নিকট হইতে মোবাইল ফুটেজ ক্রয় করিয়া বসিল, তাহার দ্বারা তো শাসক দলের মনোজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত হইতে পারে না। তবে কি তাপস চলচ্চিত্রের নায়ক বলিয়া অধিক মাসুল দিলেন? তিনি অতিপরিচিত ও অতিবন্দিত, কেবল সেই কারণে তাঁহাকে এই যথেচ্ছ বাক্যক্ষেপণের হট্টমেলায় নিশ্চিন্তে ও নিঃশর্তে কটুকাটব্য বর্ষণ করিতে দেওয়া হইল না? যে দল তাহার সদস্যদের প্রবল অসভ্যতা হাস্যমুখে বরদাস্ত করে ও পরোক্ষে ইতরতার প্রতি অনন্ত প্রশ্রয়ের বার্তা দেয়, যে দল হুমকিবাজ ও হত্যাগর্বীকে মঞ্চে তুলিয়া তাহাদের কর্মকুশলতার প্রশংসা করিয়া নিয়মিত নীচতায় মদত জুগাইয়া থাকে, সেই দলের সভ্য হইয়া তাপস কয়েকটি জিঘাংসামূলক কথা বলিয়া চিঠি দিতে বাধ্য থাকিলেন? এই বৈষম্য, একই গোত্রের অপরাধের এই ভিন্ন বিচার, শাসক দলের ও রাজ্যের ভাবমূর্তির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ক্ষমা করিয়াই ছাড়িয়া দেওয়া হইবে কেন, দুষ্ট জনগণ এই প্রশ্নও তুলিয়াছেন। তাঁহাদের বুঝিতে হইবে, ধরিবার ও ছাড়িবার ভিন্ন ব্যাকরণ রহিয়াছে। কেহ ফেসবুকে কার্টুন ছড়াইলে বা সভামঞ্চের নিকটে দাঁড়াইয়া অস্বস্তিকর প্রশ্ন করিলে তুঙ্গাবস্থিত শাসনমস্তিষ্ক উত্ত্যক্ত হয়, তাহাতে রাজ্যের নীতি-নির্ণয়ের ক্ষতি হইয়া যাইতে পারে। অন্য পক্ষে, বিরোধী দলের কুকর্মে প্ররোচিত হইয়া সঙ্গত প্রতিশোধস্পৃহায় কেহ যদি দলের শৌর্য উদ্বোধিত করিতে কিছু আকাঁড়া শব্দ বলিয়াই বসেন, তাহাতে রাবীন্দ্রিক রুচি আহত হইতে পারে বটে, কিন্তু সেই শৌখিন অস্বস্তির ফলে রাজ্যের বৃহত্তর হানি ঘটে না। ইহা ব্যতীত, একটি সুষ্ঠু শাসনতন্ত্রে, শাস্তি প্রদানের পূর্বে, দোষী ব্যক্তিটির আগুপিছু অভিনিবেশ সহকারে দেখিয়া লইতে হয়। সামান্য ফুটবলার ফাউল করিলে যত সহজে হলুদ কার্ড দেখিবেন, মেসি তাহা দেখিবেন না। গ্যালারির অশান্তির কথা ভাবিয়া রেফারি তাঁহাকে ছাড় দিবেন। তেমনই, দলের এক তারকা-নেতাকে প্রাপ্য শাস্তি দিলেই হইবে না, তাঁহার অনুগামীদের বিদ্রোহ-সম্ভাবনার কথা বিলক্ষণ মনে রাখিতে হইবে। এই দলে অন্তর্দ্বন্দ্বের শেষ নাই, প্রায়ই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মারামারির দৌলতে মানুষ নিখরচায় বলিউডি অ্যাকশন দেখিয়া লইতেছেন। সিন্ডিকেটের বখরা লইয়াও ঝামেলা চলিতেছে। ইহার মধ্যে কাহাকেও বেমক্কা শাস্তি দিয়া বসিলে ফের কোনও গোষ্ঠীর আত্যন্তিক গোঁসা হইয়া যাইতে পারে। তাহারা দল ছাড়িতে পারে, দলের ঘরদোরে আগুন লাগাইতেও পারে। তখন সেই ভাঙন সামলাইতে দলের কর্তাকর্ত্রীদিগের ঘুম ছুটিয়া যাইবে। মনে রাখিতে হইবে, শালীন বাক্যবন্ধ দ্বারা ভোট জেতা যায় না, দলদাস ক্যাডার দ্বারা যায়। কিছু অভিধানবাগীশ জ্যাঠাকে তুষ্ট করিবার অপেক্ষা সেই ক্যাডারদের পুষ্ট রাখা অধিক জরুরি। অন্তত এই ক্ষেত্রে শাসক দলের যে লঘু-গুরু বিচার ভ্রান্ত হয় নাই, ইহা আশার কথা।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy