Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু

সম্পাদক সমীপেষু

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫

ভুলে গেলেন?

‘অনেক বাঙালিরই পৌষ সংক্রান্তির কথা তখনই মনে পড়ে, যখন তাঁরা দেখেন, প্রতিবেশী নানান রাজ্য থেকে দলে দলে মানুষ গঙ্গাসাগরের পথে চলেছেন’, জহর সরকারের বক্তব্যটি (‘অনেক ভারত, এক...’, ১৫-০১) পড়ে— বহুৎ দুখী হইলহঁ/ দমে দুখ পাল্যি/ আড্ডি আড়িস্ইঞ্চ আইকেওএদা/ বড় দুঃখ পাইনু/ ঢের কষ্ট হেলা।

যে পাঁচ রকম বোলিতে দুঃখটা ব্যক্ত হল, তা নমুনামাত্র, এমন অনেক ভাষাকে এর বাইরে রাখতে হল স্থান সাশ্রয়ের জন্য। মজাটা হচ্ছে, যে ‘অনেক বাঙালি’র মধ্যে এঁরা পড়েন না, তাঁদের ভাষা-বিভাজনটা ভূখণ্ড-বিভাজিত নয়: একই এলাকায় বা গ্রামে, অনেক সময় এক বাড়িতেও এমন একাধিক বোলির চলটা সাধারণ ব্যাপার (যেমন, মকর্ দেখতে যাইঠি/ মক্র দেখতে যাউচি)।

পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কথা বলছি, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের নানা এলাকার সঙ্গেও তার ভাষা-সংস্কৃতির গভীর যোগ। এখানে ভূমিকন্যা-পুত্রদের প্রবীণ উৎসবগুলির অন্যতম মকর সংক্রান্তি। চলে প্রায় পক্ষকাল। বাল্যে এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতাম সংক্রান্তির ভোরে আগুন পোয়ানোর মহোৎসবের: গাছপালা জড়ো করে কুঁড়েঘরের মতো বানিয়ে রাখা হত, ভোর রাত্রে কনকনে ঠান্ডা জলে ডুব দিয়ে এসেই কুঁড়েতে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নেওয়া, প্রতিযোগিতা চলত কোন পাড়ার আগুনের শিখা কতটা গগনচুম্বী হয়। এর পর পিঠে খাওয়া, তিলের পুর দেওয়া, কিংবা মাংসের— মনে আছে, প্রথম শূকরের মাংস ভক্ষণ প্রতিবেশী সাঁওতাল বাড়িতে মাংস-পিঠার কল্যাণে। শ্রীসরকার বলছেন, তিল চাষ হয় না, সেটা ঠিক, কিন্তু আগের দিনে সারা বাংলা জুড়েই তিলের ব্যাপক চাষ হত: ‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর/ গড়িতেছে পিঠে পুলি অশেষ প্রকার’। বাজারের লীলায় আমাদের এলাকায় সে কালে প্রায় অলভ্য নারকেল এখন সুলভ; ‘বোরো’ চাষের একমাত্রিক কৃষির তাড়নায় তিল, ছোলা, মুগ, কুর্থি-সহ নানা রবিশস্য আজ ‘আমদানিযোগ্য’। অর্থনৈতিক পরিবর্তন বদলে দিয়েছে রাজনীতিকেও; কৃষিতে বোরো জোয়াও এবং রাজ্যে বামফ্রন্ট শাসন পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে, যাতে বোরো প্রাধান্যের মতোই রাজনৈতিক ক্ষমতায় নগর-কেন্দ্রিক ও হিন্দু উচ্চবর্ণ-কেন্দ্রিক রেনেসাঁস-লব্ধ কর্তৃত্ব অনেক জমাট হয়ে উঠেছে।

মকরের কথায় ফিরি। মকর সংক্রান্তির মেলা, এখনও এ এলাকার একটা বড় আকর্ষণ। উৎসব দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে মেলা বসে বিভিন্ন দিন। কাঠি নাচ, ঢোল, লাঠি খেলা, কাঠিগজা, চানাচুর, বাদাম ভাজা, ফিতে, ক্লিপ, খেলনা বাঁদর— চার দশক আগেও যেমন ছিল, অংশত তেমন আছে। আছে ‘মাঁস পিঠা হব্যেক মকরের’ মতোই প্রচুর হাঁড়িয়া, প্রচুর নেশা, নাচ-গান, ফুর্তি।

নানান নৃ-বৈচিত্রের মধ্যে মকরের যেমন আলাদা তাৎপর্য, তেমনই এর আছে এক সাধারণ, জনে জনে জনায়িত, একত্রিত করার বৈশিষ্ট্য। একদা মুন্ডা, সাঁওতাল, হো, মাহলি, কোড়া প্রভৃতি মুন্ডারি ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা এবং বর্তমানে কুড়মালি/ মানভুইয়াঁ-ভাষী জনসমুদয় একটিই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন: ‘খেরোয়াড়’। প্রধানত কৃষক এবং পরে পরে ঔপনিবেশিক শাসনে ভূমিচ্যুত ‘খেরোয়াড়’ গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি বসবাস গড়ে ওঠে কুমোর, কামার, তেলি, তাঁতি প্রভৃতি কারিগরিপ্রধান সমুদয়ের। তখনও এঁদের শ্রেণি-রূপগুলো ততখানি প্রকট হয়নি, ফলে সংঘাতগুলোও তীব্রতা পায়নি: স্মর্তব্য, ১৮৫৫-র সাঁওতাল অভ্যুত্থানে যোগ দিচ্ছেন কুমোর, কামাররা। পরে নানা শ্রেণিদ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে, কিন্তু আবার বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক ও অন্যান্য ঐতিহাসিক কারণে জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন থেকে গেছে। মকর সংক্রান্তি তাই আজও ‘বছরের পরব’। অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিবর্তনগুলোও এই এলাকার সঙ্গে ও রাজ্যের অন্যান্য অনেক প্রান্তিক এলাকার সঙ্গে, ‘মূলধারা’র বাংলার বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে তুলেছে। একটু বড় করে দেখলে, এই বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করতে পারত, যেমন করত উত্তরবঙ্গ বা সুন্দরবন, রাঢ় বা পৌণ্ড্র দেশের বিবিধতাগুলো সসম্মান গ্রহণ করলে।

জহর সরকার মকর সংক্রান্তির সর্বভারতীয় যোগ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছেন। সেই কারণেই আরও আক্ষেপ, তাঁর মতো মানুষও যদি ‘বৃহৎ বঙ্গ’কে বিস্মৃত হন, তবে আমরা— বাংলা ভাষাটা যাদের কষ্টার্জিত— কার উপর ভরসা করব?

হাকিম মাহাত। শান্তিনিকেতন, বীরভূম

editorial letter anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy