Advertisement
০১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

সময়হীন এক বন্দরের মতোই

আমরা কেউই যখন থাকব না, তখনও নতুন দিনের পাঠকরা উৎপলকুমার বসুর কবিতাকে আবিষ্কার করবেন সময়হীন এক বন্দরের মতোই।আমাদের যখন শুরুর দিকের যৌবন, ঠিক তখনই তাঁকে পড়া শুরু করেছিলাম। উৎপলকুমার বসুকে। কবিতা পড়বার অভ্যাস আর নেশা, দুই-ই তখন তৈরি হচ্ছে আস্তে আস্তে। সেই কাঁচা সময়টাতে তাঁর কবিতা, সযত্নে লালিত বহু ধারণাই মিহি টোকায় ভেঙে দিয়েছিল।

শ্রীজাত
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

আমাদের যখন শুরুর দিকের যৌবন, ঠিক তখনই তাঁকে পড়া শুরু করেছিলাম। উৎপলকুমার বসুকে। কবিতা পড়বার অভ্যাস আর নেশা, দুই-ই তখন তৈরি হচ্ছে আস্তে আস্তে। সেই কাঁচা সময়টাতে তাঁর কবিতা, সযত্নে লালিত বহু ধারণাই মিহি টোকায় ভেঙে দিয়েছিল। কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর মতো বিশ্লেষণ কবিতার ক্ষেত্রে আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে আমি অন্তত আজও সন্দিহান। কিন্তু তার বাইরে যে বড় পরিধিতে আমরা এক জন কবিকে পড়ে থাকি, সেখানে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ঠিক ওই রকম কবিতা আমরা তার আগে কারও কাছে পাইনি। পরেও নয়। পরে কখনও হয়তো আলাদা করে তাঁর লেখার আঙ্গিক, বিষয়, শৈলী বা দৃশ্যকল্পের ব্যবহার নিয়ে ভেবেছি মনে মনেই, কিন্তু এ সবের অনেক আগেই তিনি আমাদের চেতনার টেবিলে চতুর মুদ্রাটি নামিয়ে রেখেছেন নিঃশব্দে।

যে-সময়টার কথা বলছি, তখন কলেজের পড়াশুনো মুলতুবি রেখে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করছি। সকাল থেকে সন্ধে বিস্ময়ে মজে আছি পৃথিবীর অতুলনীয় ফিল্মগুলোর দৌলতে, আর একই সঙ্গে আমার ও আমাদের চার পাশটাকে দেখার চোখ বদলে যাচ্ছে। সেও ওই আশ্চর্য সব সিনেমারই কারণে। চার-পাঁচ জনের একটা জোট ছিলাম আমরা। তারই মধ্যে এক বন্ধু এক সন্ধেয় ঝোলা থেকে বার করেছিল উৎপলকুমার বসুর কবিতা সংগ্রহ। বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়েছি এর আগে, সমূহে ও গোগ্রাসে পড়া হয়নি। সেই শুরু হল পড়া। সারা দিন ছবি দেখার পর সেই ঘোর মাথায় নিয়ে আমরা ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে একের পর এক আউড়ে যেতাম তাঁরই কবিতা। সারা দিনের ঘোর নেশায় পরিণত হত।

পরে মনে হয়েছে, আরও তো প্রিয় কবি ছিলেন আমাদের কাছে। যদি কেবল পঞ্চাশের দশকের কথাই ধরি, শঙ্খ-বিনয়-শক্তি-সুনীল তো আমাদের কম লালন করেননি। তাঁদের সঙ্গে অলোকরঞ্জন-মণীন্দ্র-অমিতাভ আছেন। তাঁদের পূর্বসূরিদের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। তা হলে কেন আলাদা করে উৎপলকুমার আমাদের টানছিলেন সেই সন্ধেগুলোয়? সে কি কেবল নতুনকে আবিষ্কারের নির্মল আনন্দ, না তার চেয়েও বেশি কিছু? এখন বুঝতে পারি, সেলুলয়েডের মাধ্যমে ভাষার ও প্রকাশভঙ্গির যে নতুন পৃথিবী উন্মোচিত হচ্ছিল আমাদের সামনে, উৎপলকুমারের কবিতা সেই ভাষার অংশীদারি বহন করছিল। যেন বাংলা কবিতার চিরাচরিত চিহ্ন স্বীকার করেও বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া বহু দূরের জাহাজের মতো দেখাচ্ছিল তাঁর কবিতাদের। এই নিঃশব্দ উড়ান আমাদের টেনেছিল। পরে, যখন এক দিন কোর্স চলাকালীন আমাদের দুটো ক্লাস নিতে হাজির হয়েছিলেন খোদ তিনিই, আমরা নিজেদের মুগ্ধতায় শান দিয়ে নিতে পেরেছিলাম।

তাঁর সমসাময়িক কবিদের কথা বার বার এসে পড়ছে এই কারণেই যে, পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতা আমূল পাল্টে গিয়েছিল। ভাষা থেকে বিষয়, দর্শন থেকে প্রকাশ, সবটাই। সময়ের একটা নিজস্ব দাপট থাকে, পঞ্চাশের কবিরা সেই দাপটের মান রেখেছিলেন। এক দিকে শঙ্খ ঘোষের স্তিতধী, প্রতিশ্রুতিময় প্রজ্ঞাবান কাব্য, পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অস্তিত্ববাদী তাগিদ ও তুমুল প্রেম। অন্য দিকে বিনয় মজুমদারের ঘোরগ্রস্ত দার্শনিকতা ও বিষাদময় বোধ, পাশাপাশি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দিব্যোন্মাদ প্রতিভাসঞ্জাত নিখাদ যাপনের পদ্যগুচ্ছ।

এই এত কিছুর মধ্যে দিয়ে উৎপলকুমারের কবিতা বেরিয়ে এল একেবারে আলাদা একটা পথ ধরে। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল আলো-ঝলমল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া, সাধারণ চাদরে গা-ঢাকা দেওয়া এক চরিত্র, যার হাতে লুকনো রয়েছে ছুরি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল দৈনন্দিনতার একঘেয়েমিতে মোড়া এক রাজকীয়তা এবং অশান্তিময় প্রবোধ। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল নাগরিক চক্রান্তের এক অভাবনীয় আলপনা, বাস্তবের মাটি থেকে কৌতুকের হঠাৎ-উড়ান। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল সভ্য ছলনার আয়োজন ও দর্শনের আশ্চর্য সহাবস্থান। হয়ে উঠল চরম নির্লিপ্তির প্রবল পীড়া ও একই সঙ্গে পরিকল্পিত পরিহাসের মহাফেজখানা। স্টেটমেন্ট আছে হয়তো কোথাও, কিন্তু বলে দেওয়া নেই। বলে দেওয়া আছে কেবল অবজারভেশনটুকু। সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করা আছে কেবল। সে-সব জড়ো করে তাকে পড়ে নেওয়া কিন্তু পাঠকের কাজ। উৎপলকুমার বসু, খুব গোপনে ও চূড়ান্ত সফল ভাবে, পাঠককে নিজের কবিতার বাসিন্দা করে নিতে পেরেছিলেন প্রথম থেকেই।

নিরীক্ষায় বরাবর থেকেছে তাঁর সায়। ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকে ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘সলমা জরির কাজ’, ‘টুসু আমার চিন্তামণি’ হয়ে ‘সুখ-দুঃখের সাথী’, ‘পিয়া মন ভাবে’ বা ‘হাঁস চলার পথ’ পর্যন্ত নিরন্তর নিরীক্ষার চিহ্ন বহন করেছে তাঁর রচনাসম্ভার। কিন্তু সে-সব নিরীক্ষায় কোনও উচ্চকিত বিচ্ছুরণ নেই। কোনও প্রমাণের তাগিদ নেই। আছে গেরিলা অভিযানে কবিতাকে ভেঙে দিয়ে নতুন আঙ্গিক বানানো, বার বার। শব্দকে স্থির রেখে তার ব্যবহারকে আমূল পাল্টে দেওয়ার ছক, বা বাচনভঙ্গিকে দেশলাই বাক্সের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কবিতার আধার ও আকার পাল্টে দেওয়ার কৌশল। আমার বার বার মনে হয়, ‘কৌশল’ কথাটি তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে খুব জরুরি। অতিপরিচিত, আটপৌরে মোটিফ-এর বাইরে খুব বেশি দূর না গিয়েও চিন্তার শিকড় ধরে টান দেওয়া বা অস্তিত্বের গোড়া নাড়িয়ে দেওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা রাখত তাঁর প্রায় প্রতিটি রচনাই। পড়া শুরু করে প্রথমে ঝামেলাটা টের পাওয়া যায় না। মনে হয়, এ তো চেনা ঘরদোরের কথাই বলছে এক রকম, এই সমস্ত চরিত্রও তো বিশেষ কিছু নয়। শেষ করেও হয়তো চলে যাওয়া যায় অন্য কাজে। কিন্তু, ঠিক ওইখানেই লুকিয়ে রাখা আছে কৌশলখানা। কারণ পরে, অনেক পরে আবার চতুর্গুণ বিস্ময় ও পরাজয় নিয়ে ফিরে আসতে হয় সেই কবিতারই কাছে, তার পাঠ নতুন করে নেওয়ার জন্যে। ঠিক যে ভাবে, প্রবাদ বলে, অপরাধী এক বার অন্তত অপরাধের জায়গায় ফিরে আসে। সে ভাবে দেখলে, পাঠকের অপরাধপ্রবণতা নিয়েই তাঁর কারবার।

ব্যক্তি উৎপলকুমার কখনওই স্রষ্টা উৎপলকুমারকে আড়াল করেননি, তাঁর যাপনটাই ছিল সেই রকম। আমরা কেউই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা অর্জন করিনি তাঁর, দূর থেকে তাঁকে হেঁটে যেতে দেখেছি কেবল ক’বার। বাংলা কবিতার জগতের তথাকথিত ওঠাপড়া ও টানাপড়েনের অনেকটাই বাইরে তিনি রেখেছিলেন নিজেকে বরাবর। তাঁর লেখার টেবিল ও তাঁর পাঠকের মধ্যিখানে কোনও লম্বা করিডর ছিল না।

আমার বিশ্বাস, আমরা কেউই যখন থাকব না, তখনও নতুন দিনের পাঠকরা উৎপলকুমার বসুর কবিতাকে আবিষ্কার করবেন সময়হীন এক বন্দরের মতোই,
যেখানে কবিতার ছোট-বড় বহু আশ্চর্য জাহাজের অলীক ও নিশ্চিন্ত আনাগোনা।

যাবার সময়ে

তোমার নিজের মতো দূরে তুমি চলে যেতে পারো।

যাবার সময়ে শুধু আমার আগুন ছুঁয়ে যেও

যে-পথে শ্রমের চিহ্ন, যে-চলা কঠিন হবে আরও

টেবিলে রুমাল রেখে সে-পথেই হেঁটে যাওয়া শ্রেয়।

মেধার গন্ধের মতো, আবেগের স্বাদের মতোই

তোমার নিঃশব্দ থাকা, অথবা প্রবল বিচরণ

আমরা সফল শুধু। আদতে সার্থক কেউ নই।

মৃদু তাড়নার মতো জেগেছিলে, ভেতরে কখন...

পাঠক নিয়েছে পাঠ। কবিতা নিয়েছে ক্লেদ, ঘাম।

শিল্পের বিরহ থেকে সময় নিয়েছে তোমাকেও।

পায়ের ছাপের কাছে কলম নামিয়ে রাখলাম—

যাবার সময়ে শুধু আমার আগুন ছুঁয়ে যেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE