Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সরস্বতী উদ্ধার

গঙ্গা দূষণ রোধে সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট তত্‌পরতা দেখা যাইতেছে না, বরং আগ্রহের অভাবই উত্তরোত্তর নজরে পড়িতেছে। তিন বিচারপতির বেঞ্চ প্রসঙ্গত স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, এনডিএ-র নির্বাচনী ইস্তাহারে গঙ্গাশোধনে সুস্পষ্ট অগ্রাধিকারের অঙ্গীকার ছিল, যাহা আজ বিস্মৃতপ্রায়। তুলনায় অন্য অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় লইয়া সরকারকে ব্যস্ত থাকিতে দেখা যাইতেছে।

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

গঙ্গা দূষণ রোধে সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট তত্‌পরতা দেখা যাইতেছে না, বরং আগ্রহের অভাবই উত্তরোত্তর নজরে পড়িতেছে। তিন বিচারপতির বেঞ্চ প্রসঙ্গত স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, এনডিএ-র নির্বাচনী ইস্তাহারে গঙ্গাশোধনে সুস্পষ্ট অগ্রাধিকারের অঙ্গীকার ছিল, যাহা আজ বিস্মৃতপ্রায়। তুলনায় অন্য অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় লইয়া সরকারকে ব্যস্ত থাকিতে দেখা যাইতেছে। শীর্ষ আদালত আলাদা করিয়া উল্লেখ করে নাই, তবে ছয় হাজার বত্‌সর আগে লুপ্ত পৌরাণিক জলধারা সরস্বতীকে পুনঃপ্রবাহিত করাইতে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী যে উত্‌সাহ দেখাইতেছেন, সম্ভবত সেই দিকেই বিচারপতিদের ইঙ্গিত। ঋগ্বেদে উল্লেখিত সরস্বতী নদী অধুনা অস্তিত্বহীন, কিন্তু ধর্মপ্রাণ হিন্দুর বিশ্বাসে ইলাহাবাদের ত্রিবেণীসঙ্গমে গঙ্গা-যমুনার সহিত তৃতীয় যে জলধারাটি মিশিয়া আছে, তাহা সরস্বতী। সেই সরস্বতীকে তাহার ভূগর্ভের লুপ্ত ঠিকানা হইতে উদ্ধার করিয়া পুনরায় প্রবাহিত করার ভগীরথ হইতে চাহেন উমা ভারতী।

ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ কিন্তু সরস্বতীর এই কল্পিত পথ স্বীকার করে না। উপগ্রহ চিত্রের বিশ্লেষণ করিয়া একটি দূরসম্ভাব্য জলধারার যে সন্ধান মিলিয়াছে, তাহা উত্তরাখণ্ড হইতে বাহির হইয়া রাজস্থান ও গুজরাতের মধ্য দিয়া আরব সাগরে তাহার জলরাশি ঢালিয়া দিত। সেই লুপ্ত জলধারা ভূতাত্ত্বিক নানা গোলযোগের মধ্য দিয়া কেবল শুষ্ক নয়, বহু কাল যাবত্‌ কার্যত মৃত, যাহার পুনরুদ্ধার অসম্ভব। কিন্তু ইহা তো বিজ্ঞানের তথ্য, বিশ্বাস নিজের ‘সত্য’ নিজেই রচনা করে। তাই অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও সরস্বতীকে ‘গোপন ঠিকানা’ হইতে বাহিরে আনার তোড়জোড় শুরু হইয়াছিল। এখন কেন্দ্রে এনডিএ সরকারের পুনরভিষেকের পর আবার সরস্বতী-প্রসঙ্গ ফিরিয়া আসিয়াছে। কারণ এই নদী-উদ্ধারের সহিত নাকি হিন্দু ধর্মের সনাতন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পৃক্ত রহিয়াছে। হিন্দুত্বকে পুনরুজ্জীবিত করিতে হইলে অতএব সরস্বতীকেও পুনরুদ্ধার করিতে হইবে। রামেশ্বর হইতে শ্রীলঙ্কা অবধি বিস্তৃত রামায়ণী সেতুর সন্ধানে ভূতপূর্ব এনডিএ সরকারের দাবি, আন্দোলন ও মামলা-মকদ্দমার ইতিবৃত্ত বিস্মরণযোগ্য নয়।

একটি অস্তিত্বহীন জলধারার সন্ধানে ব্যাকুল না হইয়া চোখের সামনে প্রবাহিত পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গার দূষিত জলরাশিকে শোধন করার কর্তব্য অগ্রাধিকারযোগ্য নয় কি? বারাণসী লোকসভা কেন্দ্র হইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী বিজয়ের পর সন্ধ্যারতির সুষমা উপভোগের জন্য সেখানকার তটশোভা বৃদ্ধির প্রসাধনী প্রকল্প গৃহীত হইয়াছে। কিন্তু নদীর জল শোধন, নদীতীরবর্তী জনপদগুলিকে দূষণ হইতে নিবৃত্ত করা, জল-পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ সরণি হিসাবে তাহার ব্যবহার, তৃষ্ণার্ত মানুষদের বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রয়োজন মিটাইতে তাহার সংস্কার ও শুদ্ধির মতো জরুরি কৃত্যগুলি কি অবহেলিতই থাকিবে? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী গঙ্গাশোধন প্রকল্পের পথিকৃত্‌। তিনি উপরোক্ত কারণেই এই নদীর সংস্কার চাহিয়াছিলেন, পবিত্র গঙ্গাজিকে পবিত্রতর করার জন্য নয়। কেবল লোকবিশ্বাসে ‘পবিত্র’ বলিয়া নয়, উত্তর ও পূর্ব ভারতের প্রধানতম জলধারা হিসাবেই তাহার দূষণমুক্তি আবশ্যক। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী সরস্বতীর মরীচিকার পিছনে ধাবিত না হইয়া সেই দিকে মনোনিবেশ করুন। তাঁহার নেতা নরেন্দ্র মোদীই তো বলিয়াছেন, এখন দেশবাসীর দেবালয় নয়, শৌচালয়ের প্রয়োজন সমধিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE