আবার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। আবার হুমকি, ক্ষমা না চাহিলে ছাড় নাই। ভারতীয় রাষ্ট্রের ভার এখন যাঁহাদের হাতে, তাঁহাদের ব্যস্ততা সীমাহীন। চব্বিশ গুণিতক সাত তাঁহারা প্রাণপণ প্রহরা দিতেছেন, এই বুঝি বেচারা রাষ্ট্র দুর্বত্ত দ্রোহীদের পাল্লায় পড়িল। কর্নাটকে চিত্রতারকা তথা রাজনীতিক রামাইয়া শেষতম দ্রোহী সাব্যস্ত। তাঁহার অপরাধ: তিনি পাকিস্তানকে নরক ভাবেন নাই, ভালয়-মন্দয় মেশানো স্থান বলে ভাবিতেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পার্রিকর আপাদমস্তক হতবাক। তিনিই বলিয়াছিলেন, পাকিস্তান হইল নরক। রামিয়া তাঁহারই কথার প্রতিবাদ করিয়াছেন। এই ‘ভয়ঙ্কর’ রাষ্ট্রদ্রোহিতা রাতারাতি পার্রিকরদের নিদ্রা কাড়িয়া লইয়াছে। ভারতের মাটিতে জন্ম লইয়া ভারতের রাজনীতিতে যুক্ত থাকিয়াও কেহ প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে জঘন্যতম নরক কিংবা ভয়ানকতম শত্রু মনে না করিবার ধৃষ্টতা দেখাইবেন, এবং এই ধৃষ্টতা ভারতীয় রাজনীতিকে মুখ বুজিয়া সহ্য করিতে হইবে? এতখানিও কি তাঁহাদের রাজনীতির ধর্মে এবং ধর্মের রাজনীতিতে সহিবে? অন্দরে বাহিরে তাঁহাদের কোনও দ্বিমত নাই যে, বিজেপি-আরএসএস কল্পনায় ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রধানতম পরিচিতি: মুসলিম-বিরোধিতা তথা পাকিস্তান-বিরোধিতা। তাই পাকিস্তানের বিষয়ে একটিও ভাল কথা বা নিরপেক্ষ কথা বলার একটিই অর্থ: ভারত-বিরোধিতা।
স্বাধীনতার জন্মলগ্ন হইতেই যদিও ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরবিরোধিতার রাজনীতিতে জড়িত, হিন্দুত্বমণ্ডিত জাতীয়তাবাদের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য হইল সেই বিরুদ্ধতার মাত্রা যথাসম্ভব চড়াইয়া তাহা হইতে রাজনৈতিক লাভ নিষ্কাশন। নরেন্দ্র মোদীর আমলে স্বভাবতই সেই রাজনৈতিক প্রকল্প তীব্র হইতে তীব্রতর। পাকিস্তানের শিল্পীকে মুম্বইতে গাহিতে দেওয়া হইবে না, পাকিস্তানের নাম করিলেই যে কোনও অনুষ্ঠান হইতে বিতাড়িত হইতে হইবে— গত আড়াই বৎসরে শাস্তিবিহীন প্রশ্রয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়া যাওয়ায় হিন্দুত্ব-মনস্ক সমাজ বুঝিয়া গিয়াছে আরও অনেক দূর নিশ্চিন্তে আগাইয়া যাওয়া সম্ভব। আগে হইলে রামাইয়ার এই মন্তব্যে কোনও স্পর্ধিত সংকীর্ণ-ভাবাপন্ন নেতা বিরক্ত হইলেও তাঁহার বিরক্তি একটি ছোট বৃত্তের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিত, গোটা দেশে সগর্বে প্রচারিত হইত না, মামলা দায়ের হইত না, জনমানসে আলোড়ন তুলিত না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে নরেন্দ্র মোদীর রাজত্ব এই জন্যই বিশিষ্ট হইয়া থাকিবে। উদ্ধত নির্বুদ্ধিতা ও অশিক্ষাকে কেবল তাঁহারা প্রশ্রয় দেন নাই, ক্রমাগত বারিসিঞ্চন করিয়া তাহাকে পত্রপুষ্পে বিকশিত করিয়া তুলিয়াছেন। আর কয়েক বৎসর পর তাঁহাদের প্রযত্নে পরবর্তী প্রজন্ম শিখিয়া যাইবে যে, অন্যান্য সকল দেশের মতো পাকিস্তান মোটেই একটি জলমাটির দেশ নয়, সেখানে থিকথিক করে কেবল ভয়ঙ্কর ইসলামি জঙ্গিরা, যাহাদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য, ভারতকে ধ্বংস করিয়া ধুলায় মিশাইয়া দেওয়া।
সুতরাং অমিত শাহরা যাহা তত্ত্বগত ভাবে বলিতেছেন, মনোহর পার্রিকররা তাহাকেই প্রায়োগিক রাজনীতির কৌশল বানাইতেছেন। অমিত শাহ তত্ত্ব বলিয়াছেন: জাতীয়তাবাদের কথা যে বলিবে না, সেই ভারতের শত্রু। পার্রিকরদের কল্যাণে রামিয়ার ক্ষেত্রটি এ বার শত্রু-নির্ণয়ের দিগদর্শন হইয়া রহিল। অঙ্ক সহজ: পাকিস্তানের কথা বলা মানেই জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধাচরণ, রামাইয়ারাই হইলেন রাষ্ট্রদ্রোহী অর্থাৎ শত্রু। সাদাকালোয় বিভাজিত অতি সরল ও অতি বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদ কোনও কালেই স্বীকার করে নাই যে তাহার মধ্যে ভিন্ন মত, ভিন্ন ভাব, ভিন্ন ধর্ম বিরাজ করিতে পারে। এ বার সেই জাতীয়তাবাদ শিখাইতেছে, তাহার বাহিরের ভিন্নতাকেও একমাত্র একটি দৃষ্টিতেই দেখা সম্ভব। তাহা হিংসার দৃষ্টি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy