Advertisement
০৬ মে ২০২৪

দিদির উত্তর: অশোকের জয় মডেলের হার

ঘ়়ড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা ছুঁইছুঁই। জয়ের শংসাপত্র নিয়ে শিলিগুড়ি কলেজ থেকে বেড়িয়ে আসছেন অশোক ভট্টাচার্য। লাল আবিরে ঢাকা পড়েছে মুখ। গায়ের জামা। প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর হাতের আঙুলে জয়ের সংকেত দেখানো ছবি তোলার আবদার জুড়লেন চিত্র সাংবাদিকরা।

জয়ের পরে অশোক ভট্টাচার্ষ। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

জয়ের পরে অশোক ভট্টাচার্ষ। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০২:৪৪
Share: Save:

ঘ়়ড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা ছুঁইছুঁই। জয়ের শংসাপত্র নিয়ে শিলিগুড়ি কলেজ থেকে বেড়িয়ে আসছেন অশোক ভট্টাচার্য। লাল আবিরে ঢাকা পড়েছে মুখ। গায়ের জামা। প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর হাতের আঙুলে জয়ের সংকেত দেখানো ছবি তোলার আবদার জুড়লেন চিত্র সাংবাদিকরা।

আর সেই মুহূর্তেই যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।

তৃণমূলের ভরা বাজারে ২০১৪ তে শিলিগুড়ি পুরবোর্ড দখলে এনেছিল বামেরা। ২০১৫তে মহকুমা পরিষদের নির্বাচনেও মিলেছিল সাফল্য। দুইয়েরই কারিগর তিনি। বিরোধীদের একম়ঞ্চে আনার সেই দাওয়াই পরে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ নামে জায়গা করে নেয় রাজ্য রাজনীতির ডিকশনারিতে। বিরোধী মহলে স্বপ্ন দেখা শুরু হয় এই শব্দ ঘিরে। এরপর বিধানসভা ভোটের দামামা বাজতেই কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট গঠনের সিদ্ধান্তের পিছনেও এই অঘোষিত ‘মডেলে’র বীজ দেখেছে রাজনৈতিক মহল।

কিন্তু গোটা রাজ্য তো বটেই, ভোটের ফলে দেখা গিয়েছে উত্তরবঙ্গেও একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে বাম-কংগ্রেস জোট। চা বলয়ের দুই জেলা জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার তো বটেই, কোচবিহারেও ছবিটা তা-ই। জোটের বাতাস ততটা জোরালো হয়নি উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরেও। একমাত্র মালদহ ও দার্জিলিঙে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে শাসক দলকে।

যদিও মালদহে তৃণমূলের হারের জন্য দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কারণ বলে মনে করছেন জোটেরই অনেক নেতা।

যেমন ইংরেজবাজারের একাধিক তৃণমূল কর্মী জানান, ‘‘কিসানদা (কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী এই নামেই দলের পরিচিত) যাতে না জেতেন, সে জন্য ৪-৫টা ওয়ার্ডে দলের কিছু লোক উদয়াস্ত কলকাঠি নাড়িয়েছেন। আবার মানিকচকে সাবিত্রীদির এক ঘনিষ্ঠের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ এতটাই চরমে ছিল যে, দলের একাংশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।’’ তাঁরাই জানান, ওই নেতাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে সাবিত্রীদিকেই হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার দক্ষিণ দিনাজপুরে যুযুধান বিপ্লব মিত্র, শঙ্কর চক্রবর্তীর অনুগামীদের কয়েক জন আক্ষেপ করেন, জোটের থেকেও নিজেদের খেয়োখেয়ির ফলই ভুগতে হচ্ছে এখন। তাই তপন ও কুশমন্ডি বাদে বাকি ৪টি আসনই বাম-কংগ্রেস জোটের দখলে।

প্রশ্ন উঠেছে, কোচবিহারেও তো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কম নেই। তা হলে সেখানে কী ভাবে ৯টির মধ্যে ৮টি আসনই দখল করেছে তৃণমূল? কোচবিহারে বাম ও কংগ্রেসের যৌথ শক্তিও তো হেলাফেলা করার নয়। সে কথাটা তৃণমূলই বরাবর মেনে নিয়েছে। তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতির রবীন্দ্রনাথ ঘোষের যুক্তি, ‘‘আমরা দলের ঘরোয়া বৈঠকে স্পষ্ট বলেছিলাম, সারা বছর নিজেদের মধ্যে যতই দলাদলি করুন, ভোটের সময়ে বেগড়বাই করলে কিন্তু আগামী পাঁচ বছরের জন্য কপালে দুঃখ রয়েছে। তখন জোট নেতাদের পায়ে মাথা কুটে মরতে হবে। শেষ পর্যন্ত সকলে একজোট থাকায় বিপক্ষ জোট আর খাপ খুলতে পারেনি।’’

কোচবিহারের মতো চা বলয়ের দুই জেলা জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারেও খাপ খুলতে পারেনি জোট। আলিপুরদুয়ারের ৫টি আসনের মধ্যে ৪টি পেয়েছে তৃণমূল। একটি বিজেপি। জোট শূন্য। জলপাইগুড়িতে ৭টি আসনের মধ্যে জোট পেয়েছে মাত্র ১টি। বাকি সবই শাসক দলের দখলে চলে গিয়েছে। চা বলয়ে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন এখনও জোরদার নয়। তা সত্ত্বেও শিলিগুড়ি মডেলকে ছাপিয়ে যাওয়ার রহস্য কী?

আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি— দুই জেলাতেই তৃণমূলের দায়িত্বে রয়েছেন সৌরভ চক্রবর্তী। তিনি নিজেও জিতেছেন। তিনি বলেন, ‘‘বারবার দলনেত্রী আমাদের দুই জেলায় এসেছেন। আলিপুরদুয়ার জেলাটা তো ওঁর হাতেই তৈরি। চা বাগানের সমস্যা মেটাতে মুখ্যমন্ত্রী কতটা আন্তরিক সেটাও সকলে বোঝেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কীসের জোট, কেন জোট— সেটাও মানুষ বুঝে গিয়েছেন।’’

স্বপ্নভঙ্গের পর সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির অফিসে বসেই শিলিগুড়ি মডেল-এর কথা শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন কয়েক জন নেতা। সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য বলেন, ‘‘মানুষ সব কিছু গ্রহণ করে না। এ ক্ষেত্রেও জোটকে গ্রহণ করতে পারেনি। এ সব মডেল-টডেল নিয়ে আমি কোনও দিন আগ্রহী নই। কিছুই বলিওনি।’’

‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর এ ভাবে মুখ থুবড়ে পড়া দেখে তাই অতি মাত্রায় সাবধানী হয়ে গিয়েছেন খোদ অশোক ভট্টাচার্যও। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ির কলেজের গণনা কেন্দ্র থেকে বার হওয়ার মুখে তাঁর মন্তব্য, ‘‘কীসের শিলিগুড়ি মডেল? আমি কখনও শিলিগুড়ি মডেল বলে কোথাও কিছু বলিনি। ওটা আমার কথা নয়। যাঁরা মডেলের কথা বলেন, দায়িত্ব তাঁদের।’’

‘‘দার্জিলিং জেলায় তৃণমূল শূন্য। আপনি জিতেছেন। মোর্চা জিতেছে পাহাড়ে। শিলিগুড়ির সমতলে দুটি আসনে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। তা হলে গোটা রাজ্যে শিলিগুড়ি মডেল-এর এমন বেহাল দশা কেন?’’ এই প্রশ্নে যেন কিছুটা বিব্রত দেখায় তাঁকে। অশোকবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যে জোটের বিপর্যয় হয়েছে বৈকি। কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। তবে আমি তো বড় নেতা নই। ছোট নেতা। জেলার নেতা। এ সব নিয়ে বলা সাজে না। দু’দিনের মাথায় রাজ্য কমিটির বৈঠকে শীর্ষ নেতারাই নিশ্চয়ই সব বিশ্লেষণ করে মত দেবেন।’’

ঘটনা হল, ভোট প্রচারে এসে একাধিকবার তৃণমূল নেত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘শিলিগুড়ি মডেল-টডেল ধোপে টিঁকবে না। ওটা খায় না মাথায় দেয় কেউ জানে না।’’ সে সময়ে তৃণমূল নেত্রীর কড়া সমালোচনা করেছিলেন অশোকবাবুরাও। এখন সেই অশোকবাবু বলছেন, ‘‘যাঁরা জিতেছেন তাঁদের সমালোচনা করব না। বরং এটা বলব, ‘বুথ দখল করে নয়, মানুষের ভোটেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE